১. মহাশ্বেতা দেবী রচিত ‘ভাত’ ছোটোগল্পের ‘বড়ো বাড়ি’র চার পুত্র ও পুত্রবধূর পরিচয় দাও ? ১×৫
উত্তর বড়ো বাড়ির চার পুত্রের পরিচয়: মহাশ্বেতা দেবী রচিত ‘ভাত’ ছোটোগল্পে ‘বড়ো বাড়ির’ যে অশীতিপর বৃদ্ধের মৃত্যু বর্ণিত হয়েছে, তাঁর ছিল চার পুত্র ও পুত্রবধূ। বড়ো, মেজো এবং ছোটো পুত্র বাড়িতে থাকলেও সেজো পুত্র বিলেতে থাকে। বাড়িতে থাকা তিন পুত্রই ছিল অত্যন্ত অলস-“এ বাড়ির ছেলেরা বেলা এগারোটার আগে ঘুম থেকে ওঠে না।” যেহেতু বাড়ির জ্যেষ্ঠ বুড়োকর্তার দূরদর্শিতায় আঠারোটা দেবত্র বাড়ি এবং বাদা অঞ্চলের অনেক উর্বর জমি তাদের অধিকারে, তাই তারা ছিল ভীষণ কর্মবিমুখ এবং উপার্জনবিমুখ। বড়ো বাড়ির চার পুত্রবধূর পরিচয়। বড়ো বাড়ির পুত্রবধূরা ছিল অত্যন্ত কর্মপটু এবং কর্তব্যসচেতন। এ গল্পে ছোটোবউয়ের বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায় না, কেবল তার পিতা যে বুড়োকর্তাকে সুস্থ করার জন্য তান্ত্রিক নিয়ে এসেছিলেন, সেটুকুই জানা যায়। অন্যদিকে, মেজোবউ শাশুড়ির সম্ভাব্য বৈধব্যের আশঙ্কায় তাকে বড়ো ইলিশ, বড়ো ভেটকি, চিতলের কোল, ডিমপোরা ট্যাংরা, পাকাপোনার পেটি প্রভৃতি মাছের বিভিন্ন পদ রান্না করে খাওয়ায়। আবার বড়োবউয়ের চরিত্রটি উল্লেখযোগ্য একটি চরিত্র। শ্বশুর তার কাছে ঠাকুরদেবতা সমান” ছিল। সে শ্বশুরের জন্য প্রতিদিন দই পেতে সেই দইয়ের সঙ্গে ইসবগুল মিশিয়ে শরবত বানাত। শ্বশুর খেতে আসার পাঁচ মিনিট আগে বড়োবউ তাঁর জন্য ত্রুটি বা লুচি তৈরি করে দিত। এ ছাড়া, প্রতিদিন শ্বশুরের বিছানা করা এবং তাঁর পা টিপে দেওয়ার কাজও সে করত ।
২. “তাঁর বিয়ে হয়নি।”-‘তাঁর’ বলতে এখানে কার কথা বলা হয়েছে? তাঁর বিয়ে না হওয়ার কারণ কী? ১-৪
উত্তর উদ্দিষ্ট ব্যক্তি:- মহাশ্বেতা দেবীর লেখা ‘ভাত’ ছোটোগল্প থেকে নেওয়া আলোচ্য উদ্ধৃতিটিতে ‘তাঁর’ বলতে বড়োপিসিমার কথা বলা হয়েছে।
বড়ো পিসিমার বিয়ে না হওয়ার কারণ। বড়োপিসিমা বড়ো বাড়ির বউদের পিসিশাশুড়ি হন। এত বড়োলোক বাড়ির মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও তাঁর বিয়ে হয়নি। তাঁর অবিবাহিত থাকা সম্বন্ধে নানা জন নানা ব্যাখ্যা দেন। চারপাশের সবাই বলে যে, বড়ো বাড়ির সংসার সামলানোর জন্যই নাকি পয়সা থাকা সত্ত্বেও বড়োপিসিমার বিয়ে দেওয়া হয়নি। বড়োপিসিমা যখন বিয়ের উপযুক্ত হন, তখন ওই বাড়ির জ্যেষ্ঠ বুড়োকর্তার স্ত্রীর মৃত্যু ঘটে। ফলে তখন বুড়োকর্তা সংসার নিয়ে নাজেহাল হচ্ছিলেন। তাই আর তিনি কন্যার বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেননি। আবার অনেকের মতে, বড়োপিসিমা নিজেই নাকি বলেছিলেন, শিবঠাকুরই তাঁর পতিদেবতা। তাই কোনো মানুষের সঙ্গে বড়োপিসিমা তাঁর বিয়ে দিতে বারণ করেছিলেন। বড়ো বাড়ির লোকেরাও তেমনটাই বিশ্বাস করে। এসব কথা সত্যি না মিথ্যে তা কেউ জানে না।
৩. মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ ছোটোগল্প অবলম্বন করে ঝড়জল- বন্যার রাতটির বর্ণনা দাও ?
উত্তর ঝড়জল-বন্যার রাতের বর্ণনা:- প্রশ্নে উদ্ধৃত ঝড়জল-বন্যার রাত উচ্ছবকে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছিল। সেদিন সন্ধ্যাতেই অনেকদিন পর সপরিবারে উচ্ছব পেট পুরে ভাত খেয়েছিল। খেতে খেতে চল্গুনীর মা বলেছিল যে, দেবতার গতিক ভালো নয়। নৌকা নিয়ে যারা বেরিয়েছিল, তাদের নৌকা-সহ ডুবে মরে যাওয়ার আশঙ্কাও সে প্রকাশ করেছিল। এরপরই শুরু হয় প্রবল ঝড়-বৃষ্টি। ঝড়- বৃষ্টিতে উচ্ছবদের কাঁচা বাড়ির মাঝ-খুঁটিটি ‘মাতাল আনন্দে টলছিল’ ধনুষ্টংকার রোগীর মতো। তাই উচ্ছব সর্বশক্তি দিয়ে ঘরের মাঝখানের খুঁটিটা মাটির দিকে চেপে ধরে ছিল। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল মা বসুন্ধরা যেন সেই খুঁটি রাখতে চাইছেন না, ঠেলে বের করে দিতে চাইছেন। তাই ভয়ে ভগবানের নাম নিতে থাকে সে। অন্যদিকে, ছেলেমেয়েকে জাপটে ধরে তার বউ ঠান্ডায় এবং ভয়ে কাঁপতে থাকে। এ সময়েই হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানিতে উচ্ছব দেখতে পায় মাতাল মাতলা নদীর সফেন জল বাতাসের তোড়ে দ্রুত ছুটে আসছে। পরে একসময় জল নেমে গেলেও উচ্ছবের ঘরের সব কিছু এবং তার পরিবারকে উচ্ছব আর খুঁজে পায়নি, সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায় সেই জল। বানের জলে ভেসে যাওয়া উচ্ছব গাছে বেধে কোনোক্রমে প্রাণে বাঁচে। এভাবে ঝড়জল- বন্যার সেই রাত উচ্ছবের জীবনে সর্বনাশ ডেকে এনেছিল ।
৪. “তারপরই মনে পড়ে যে রাতে ঝড় হয়।”-কোন কথার পর ঝড়ের রাতের কথা উদ্দিষ্ট ব্যক্তির মনে পড়ে? কোন্ কোন্ কথা এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে তার? ১+৪
উত্তর:- মনে পড়ার পরিপ্রেক্ষিত। মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ ছোটোগল্প থেকে সংকলিত এই উদ্ধৃতিটিতে উচ্ছব নাইয়ার কথা বলা হয়েছে। ধান খেতে আগুন লাগার কথা মনে পড়ার পরে উচ্ছবের ঝড়ের রাতের কথা মনে পড়ে। প্রসলাত মনে পড়া কথাগুলি:- উচ্ছব নাইয়ার এ প্রসঙ্গে মনে পড়েছিল যে, অনেকদিন পর সেই সন্ধ্যায় সে পরিবার-সহ পেটপুরে খেয়েছিল। অনেকটা হিন্দেশাক সেদ্ধ, গুগলি সেখ, নূন এবং লংকাপোড়া দিয়ে মেখে ভাত খেয়েছিল সে। সেদিন উচ্ছবের মতো গ্রামের সকলেই পেট পুরে খেয়েছিল। চন্ননীর মা খাওয়ার সময় বলেছিল যে, ভগবানের লক্ষণ ভালো নয়। সে আরও বলেছিল যে, নৌকো নিয়ে যারা বেরিয়েছে, তারা নৌকা-সহ ডুবে মরতে পারে। এরপর উচ্ছবের মনে পড়ে ঘরের মাঝ-খুঁটিটা মাটির দিকে ঠেলে ধরে রাখার কথা। ধরণি যেন সেই খুঁটি উপড়ে ফেলতে চাইছিল। ভগবানের নাম নিয়েছিল উচ্ছব। তারপর বিদ্যুতের চমকে সে দেখেছিল, মাতলার সফেন জল ছুটে আসছে। তারপর আর কিছু মনে পড়ে না তার, নিজের পরিচয় পর্যন্ত। উচ্ছব ভাবে, তার কাগজ-ভরা, সুন্দর কৌটোটির কথা। আরও ভাবে, ভগবান যদি তার বউ- ছেলেমেয়েদের বাঁচিয়ে রাখত, তবে সে শত হাতির শক্তি পেত। সেই কৌটোটি নিয়ে তবে সপরিবারে সে ভিক্ষায় বেরোত। সতীশবাবুর নাতির ফুড খাওয়ার কৌটোটি উচ্ছব চেয়ে এনেছিল। অমন সুন্দর কৌটো থাকলে প্রয়োজনে একমুঠো চাল ফুটিয়েও নেওয়া যায়।
৫.ফুটন্ত ভাতের গন্ধ তাকে বড়ো উতলা করে।” কার কথা বলা হয়েছে? এই গন্ধ তাকে উতলা করে কেন? ১-৪
উত্তর:উদ্দিষ্ট ব্যক্তি:- মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ গল্পে উল্লিখিত মন্তব্যে উচ্ছব নাইয়া-র কথা বলা হয়েছে।
উতলা হওয়ার কারণ:- বাদা অঞ্চলের বাসিন্দা হলেও উচ্ছবের জীবনে ভাতের অভাব চিরকালের। শহরের বড়ো বাড়িতে বাদা থেকে আসা চালের প্রাচুর্যে সে অবাক হয়ে যায়, কারণ তার বাদায় শুধু ‘গুগলি-পেঁড়ি-কচুশাক- সুশনো শাক’ জন্মায়। ভূমিহীন উচ্ছব গ্রামে সতীশবাবুর জমিতে কাজ করে কয়েকমাস খাওয়ার ব্যবস্থা করতো। কিন্তু তা সারাবছরের নয়। মাতলার বন্যায় যেদিন তার স্ত্রী-সন্তানরা ভেসে যায় সেদিনই সন্ধ্যায় অনেকদিন পরে সে ভাত খেয়েছিল। কিন্তু ভেসে যাওয়া মানুষগুলোকে খুঁজতে গিয়ে ত্রাণের খিচুড়ি তার খাওয়া হয়নি। খিদের যন্ত্রণা সে সারাজীবন সহ্য করেছে। পরিবার হারানোর পরে তা আরও তীব্র হয়েছে। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্যই সে শহরের বড়ো বাড়িতে কাজ করতে এসেছে। সেখানে চালের বিপুল সম্ভার তার খিদেকে আরও বাড়িয়ে দেয়। কষ্ট অসহনীয় হলে সে বাসিনীর কাছে জল দিয়ে খাওয়ার জন্য একমুঠো চাল চায়। তান্ত্রিকের বিধানে খাওয়ার সময় পিছিয়ে যাওয়ায় খিদের তাড়না আরও বেড়ে যায়। রান্না হওয়া সত্ত্বেও সে খেতে পাচ্ছে না-এই অসহনীয় অবস্থায়, ক্ষুধার্ত উচ্ছব ভাতের গম্বে উতলা হয়ে ওঠে।
৬.”মারতে মারতে উচ্ছবকে ওরা থানায় নিয়ে যায়।” কারা,কেন উচ্ছবকে মারতে মারতে থানায় নিয়ে যায়? প্রতিটি প্রধোর পূর্ণমান ৫
উত্তর:- উদ্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক উচ্ছবকে মারার কারণ:- মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ ছোটোগল্পে মাতলা নদীর বন্যায় সর্বস্ব-হারানো উচ্ছব ভাতের আশায় তার গ্রামতুতো বোন বাসিনীর মনিবের বাড়ি কলকাতায় চলে আসে। সেখানে ভাত খাওয়ার বিনিময়ে তাকে সেই বাড়ির বড়োকর্তার আয়ুবৃদ্ধির জন্য করা হোমযজ্ঞের কাঠ কাটতে হয়েছিল। এদিকে তান্ত্রিকের বিধান অনুযায়ী, যজ্ঞ শেষ না-হওয়া পর্যন্ত কোনো কিছু খাওয়া বারণ ছিল। তাই খিদের জ্বালায় অস্থির হয়ে-পড়া উচ্ছবও ভাত খেতে পারেনি। মাঝে বাসিনীর দেওয়া ছাতু জল খেয়ে খিদে মেটানোর চেষ্টা করে উচ্ছব। যদিও এই সামান্য খাবারে তার পেট ভরেনি। তার সামনে অপ্রত্যাশিত সুযোগ চলে আসে বড়োকর্তার মৃত্যুর পরে। বড়ো পিসিমার নির্দেশে রান্না খাবার ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলে উচ্ছব ভাতের বড়ো ডেকচিটা চেয়ে নেয় ফেলে দেওয়ার জন্য। তারপরে দ্রুত হেঁটে, পরে এক দৌড়ে স্টেশনে গিয়ে মনের সুখে ভাত খায়। অনেকদিন পরে আশ মিটিয়ে ভাত খেয়ে স্টেশনেই তৃপ্ত উচ্ছব সেই পেতলের ডেকচিটি জাপটে, তার কানায় মাথা ছুঁয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন ভোরে পুলিশ ঘুমন্ত উচ্ছবকে স্টেশনেই ধরে ফেলে এবং পেতলের ডেকচি চুরির অপরাধে তাকে মারতে মারতে থানায় নিয়ে যায়।
৭.”সে বুঝতে পারে সব ভাত ওরা পথে ফেলে দিতে যাচ্ছে।”- ‘ওরা’ বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে? ওরা সব ভাত ফেলে দিতে যাচ্ছিল কেন? ‘সে’ কে? বুঝতে পেরে সে কী করেছিল? ১+১+১+২
উত্তর:- মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ গল্পের উল্লিখিত অংশে ‘ওরা’ বলতে বাসিনীর মনিব বাড়ির কথা বলা হয়েছে।
বাড়ির বড়োকর্তার মৃত্যুর কারণে অশৌচ হওয়ায় বড়োপিসিমা নির্দেশ দিয়েছিলেন সব ভাত ফেলে দেওয়ার জন্য।
‘সে’ বলতে এখানে উচ্ছব নাইয়ার কথা বলা হয়েছে।
ক্ষুধার্ত উচ্ছব ভাত ফেলে দেওয়ার নির্দেশ শুনে দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায় এবং “… মাথার মধ্যে যে মেঘ চলছিল তা সরে যায়।” সে এটাকে তার ক্ষুধা- নিবৃত্তির অভাবিত সুযোগ বলে মনে করে। স্থির বুদ্ধিতে উচ্ছব বাসিনীর কাছ থেকে মোটা চালের ভাতের বড়ো ডেকচিটা চেয়ে নেয় দূরে ফেলে দিয়ে আসার জন্য। তারপরে সে দ্রুত হাঁটতে থাকে। বাসিনী তার অভিসন্ধি অনুমান করে অশৌচ বাড়ির ভাত খেতে নিষেধ করলে উচ্ছব কামটের মতো হিংস্র ভঙ্গিতে পিছনে ফিরে তাকায়। তারপরে দৌড়োতে দৌড়োতে নিরুপদ্রবে ভাত খাওয়ার স্বর্গসুখ পাওয়ার জন্য স্টেশনে পৌঁছে যায়।
৮.বাদার ভাত খেলে তবে তো সে আসল বাদাটার খোঁজ পেয়ে যাবে একদিন।” ‘বাদা’ কাকে বলে? উদ্দিষ্ট ব্যক্তির এই রকম মনে হওয়ার কারণ কী?
উত্তর বাদা:- মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ ছোটোগল্প থেকে গৃহীত উদ্ধৃতাংশে থাকা ‘বাদা’ শব্দটির অর্থ হল জল-জঙ্গলপূর্ণ নীচু জমি।
এরকম মনে হওয়ার কারণ:- ঝড়-বৃষ্টির যে রাতে উচ্ছব তার স্ত্রী ও পুত্র- কন্যাকে হারিয়েছিল, সেদিন সন্ধ্যায় উচ্ছব অনেকদিন পরে পেট ভরে সপরিবারে ভাত খেয়েছিল। তারপর সর্বস্বান্ত উচ্ছব তার বন্যাবিধ্বস্ত ভিটেতে উন্মাদের মতো কয়েকদিন পড়ে ছিল, তাই লঙ্গরখানার ‘রান্না খিচুড়ি তার খাওয়া হয়নি’। তার যখন সম্বিত ফেরে তখন রান্না খাবার দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। কাঁচা চাল চিবিয়েই তাই তার দিন কাটতে থাকে। উচ্ছব যার জমিতে কাজ করত, সেই সতীশ মিস্তিরিও তাকে ভাত দিতে অস্বীকার করে। ভাতের আকাঙ্ক্ষাতেই উচ্ছব কলকাতায় গ্রামতুতো বোন বাসিনীর মনিববাড়িতে কাজ করতে আসে। সুন্দরবনের নোনা জলের বাদার অধিবাসী উচ্ছব দেখে যে, বাসিনীর মনিবদের মিষ্টিজলের বাদায় হওয়া নানাপ্রকার চালে তাদের ঘর ভরে আছে। সে-বাড়ির বড়োকর্তার মৃত্যু হলে তারা যখন বাড়ির সমস্ত ভাত এবং অন্যান্য রান্না খাবার ফেলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে, তখন অভুক্ত উচ্ছব আর মাথা ঠিক রাখতে পারে না। বাসিনীর হাত থেকে অশৌচ বাড়ির ভাতের ডেচকিটা ছিনিয়ে নিয়ে সে স্টেশনে ছুটে আসে এবং সেখানেই ভাতে হাত দিয়ে সে স্বর্গসুখ লাভ করে উচ্ছব। তার মনে হয়, মিঠে জলের বাদার ভাত খেলেই সে ‘আসল বাদা’ অর্থাৎ ‘অন্নের দেশ’-এর খোঁজ পেয়ে যাবে ।
৯.আসল বাদাটার খোঁজ করা হয় না আর উচ্ছবের।”- উচ্ছবের পরিচয় দাও। তার পক্ষে আসল বাদাটার খোঁজ করা হয়ে ওঠেনি কেন?
উত্তর উচ্ছবের পরিচয়:- মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ গল্পের প্রধান চরিত্র উচ্ছব নাইয়া, মাতলার বন্যায় সর্বস্বান্ত হওয়ার পরে যে শহরে কাজ করতে চলে আসে একটু ভাতের আশায়।
খোঁজ না করার কারণ। শহরের বড়োবাড়িতে কাজের বিনিময়ে খেতে পাবে বলে উচ্ছব কাজ করতে আসে। কিন্তু লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত বড়োকর্তাকে বাঁচানোর জন্য যে হোমযজ্ঞের আয়োজন হয়, তার তান্ত্রিকের নির্দেশে খাবারের সময় বারেবারে পালটে যেতে থাকে। ক্ষুধার্ত উচ্ছবের সামনে অভাবিত সুযোগ চলে আসে বড়োকর্তার মৃত্যুর পরে। বড়ো পিসিমা আদেশ দেন সমস্ত রান্না পথে ফেলে দিতে। উচ্ছব ফেলে দেওয়ার জন্য সবথেকে ভারি ডেকচিটা বাসিনীর কাছ থেকে চেয়ে নেয়। নিয়ে দ্রুত চলতে শুরু করে। বাসিনীর নিষেধ তাকে ফেরাতে পারে না। স্টেশনে পৌঁছে ভাতে হাত দিয়ে সে স্বর্গসুখ পায়। কিন্তু সেই ভাত খেয়ে সে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন পিতলের ডেকচি চুরির অপরাধে উচ্ছবকে সেখান থেকে মারতে মারতে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। উচ্ছব এতদিন ভাবত যে, বাদার ভাত খেলে আসল বাদা অর্থাৎ যেখানে ফসল ফলে তার সন্ধান সে পেয়ে যাবে। কিন্তু ভাত খাওয়া হলেও শেষপর্যন্ত বাদাটার খোঁজ করা তার পক্ষে আর সম্ভব হয় না।
১০.মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ ছোটোগল্পে যে হোমযজ্ঞ হয়েছিল, তার বর্ণনা দাও ?
উত্তর। উপলক্ষ্য:- মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ ছোটোগল্পে ক্যানসারে আক্রান্ত, বিরাশি বছরের কর্তাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে শহরের বড়োবাড়িতে হোমযজ্ঞের আয়োজন করা হয়েছিল। বুড়োকর্তার ছোটোবউমার বাবা পরিচিত এক তান্ত্রিককে এই উপলক্ষ্যে সেই বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন।
আয়োজন:- যজ্ঞের জন্য বেল, ক্যাওড়া, বট, অশ্বত্থ এবং তেঁতুল গাছের কাঠ আধ মন করে আনা হয়েছিল। সেই আড়াই মন কাঠের প্রতিটি খন্ড দেড় হাত করে কাটতে বলা হয়েছিল গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র উচ্ছবকে। কালো বিড়ালের লোম, শ্মশানের বালি ইত্যাদি নানাপ্রকার জিনিসের ফরমাশ করেছিলেন তান্ত্রিক। প্রথমে হোমযজ্ঞের আগে রান্না এবং খাওয়া শেষ করার কথা থাকলেও, তান্ত্রিক নতুন বিধান দিয়েছিলেন য়ে রান্না শেষ করলেও হোম সম্পন্ন না হলে কেউ খেতে পারবে না। উচ্ছব যজ্ঞের জন্য কাটা কাঠের টুকরোগুলি পাঁচ ভাগে ভাগ করে দালানে রেখে আসার পর শুরু হয় হোমযজ্ঞ। বুড়োকর্তার খাস-ঝি হোমের জোগান দিচ্ছিল।
যজ্ঞ ও তার পরিণতি:- তান্ত্রিক “ওঁং হ্রীং ঠং ঠং ভো ভো রোগ শুধু শৃণু”- মন্ত্র বলে বুড়োকর্তার রোগকে দাঁড় করান, কালো বিড়ালের লোম দিয়ে রোগকে বাঁধেন এবং তারপর বুড়োকর্তার তিন ছেলের উপস্থিতিতে হোম শুরু করেন। যদিও এই হোমযজ্ঞ শুরু হওয়ার ঠিক পরমুহূর্তেই বুড়োকর্তা মারা যান।
১১.মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ ছোটোগল্পে বুড়োকর্তার মৃত্যুর পর বড়ো বাড়িতে কী কী ঘটনা ঘটেছিল?
উত্তর। বুড়োকর্তার মৃত্যু পরবর্তী ঘটনাসমূহ:- মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ ছোটোগল্পে বর্ণিত বড়ো বাড়ির বুড়োকর্তা বিরাশি বছর বয়সে লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে যেদিন মারা যান সেদিনই তাঁকে বাঁচাতে হোমযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর বাড়ির মহিলা এবং পরিচারিকারা স্বভাবতই কাঁদতে থাকে। বড়োপিসিমা কাঁদতে কাঁদতে তান্ত্রিককে এবং বাড়ির ছোটো বউয়ের বাবাকে দোষারোপ করতে থাকেন ‘ডাকাতে সন্নেসী’ আনার জন্য। তার ধারণা হয়েছিল আটানব্বই বছরের পরিবর্তে বিরাশি বছরেই কর্তার মৃত্যুর কারণ তান্ত্রিকের অক্ষমতা। রাতেই ঠিক মৃতদেহ নেওয়া হয় হয় যে, বুড়োকর্তার সৎকার করা এবং খই, ফুল, হবে। মেয়েরা এবং পুরোহিতকে কীর্তনের দল আসার বলে প্রয়োজনীয় পর সে জিনিসের ধুতি, শববস্ত্র ইত্যাদির জোগাড় চলতে থাকে। ফর্দ চন্দন বাঁটা চলতে থাকে, খাট আনতে একজনকে বাগবাজারে পাঠানো হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা বোম্বাই খাট এসে যায়। মহিলারা মাঝেমধ্যেই কেঁদে উঠলেও শোকের বিশেষ চিহ্ন দেখা যায় না কারও মধ্যে। বাড়ির উনুন জ্বলবে না বলে রাস্তার দোকান থেকে চা আসতে থাকে। অবশেষে রাত একটার পর বোম্বাই খাটে শুইয়ে বৃদ্ধের মৃতদেহ বের করা হয়। পেশাদারি শববাহকরা তা দ্রুতগতিতে শ্মশানে নিয়ে যেতে থাকে। পেছন পেছন দৌড়ে যায় কীর্তনের দল। বাড়ির সব রান্না ফেলে দিয়ে ঘরদুয়ার সাফ করা শুরু হয়।
১২.মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ ছোটোগল্প অবলম্বনে বুড়োকর্তার চরিত্র বিশ্লেষণ করো।
উত্তর মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ ছোটোগল্পের ‘বড়ো বাড়ি’র দুই প্রজন্মের দুই কর্তাকেই যেহেতু লেখিকা ‘বুড়োকর্তা’ বলে অভিহিত করেছেন, তাই বুড়োকর্তার চরিত্র বলতে আমরা জ্যেষ্ঠ বুড়োকর্তা এবং কনিষ্ঠ বুড়োকর্তা এই দু-জনের চরিত্রই বুঝব।
জ্যেষ্ঠ বুড়োকর্তার চরিত্র:- প্রয়াত জ্যেষ্ঠ বুড়োকর্তা ছিলেন বড়োপিসিমার পিতা। বড়োপিসিমা যখন বিয়ের উপযুক্ত হন, তখন তাঁর মা অর্থাৎ জ্যেষ্ঠ বুড়োকর্তার স্ত্রী মারা যান। স্ত্রীবিয়োগের পর সংসার দেখার জন্যই তিনি তাঁর কন্যার বিয়ে দেননি। তবে, তিনি ‘দূরদর্শী লোক ছিলেন’, আর তাঁর জন্যই বর্তমান প্রজন্ম কোনো কাজ না করেও বহাল তবিয়তে খেয়ে-পরে ছিল। তাঁর বাড়ির রাস্তার সবগুলি বাড়িই তিনি শিব, মহেশ্বর, ত্রিলোচন, উমাপতি ইত্যাদি বহু নামে শিবঠাকুরকে দিয়ে গিয়েছিলেন। ফলে, তাঁর দৌলতেই আঠারোটা দেবত্র বাড়ি এবং বাদা অঞ্চলের বিস্তৃত, উর্বর জমি বড়ো বাড়ির অধিকারভুক্ত হয়। বড়ো বাড়ির বিশাল বসতবাড়িটা এবং বাড়ির শিব মন্দিরটাও সম্ভবত তিনিই তৈরি করিয়েছিলেন।
কনিষ্ঠ বুড়োকর্তার চরিত্র:- জ্যেষ্ঠ বুড়োকর্তার পুত্র হলেন কনিষ্ঠ বুড়োকর্তা, ‘ভাত’ ছোটোগল্পে যে বৃদ্ধের মৃত্যু দেখানো হয়েছে, তিনি। চার পুত্র এবং বেশ কয়েকটি কন্যা সন্তানের পিতা ছিলেন এই মানুষটি। বড়োবউমার সঙ্গে তাঁর অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। বিরাশি বছরে পৌঁছেও তিনি বেশ শক্তসমর্থ ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে বিরাশি বছরে তাঁর মৃত্যু হয়, যদিও তাঁর নাকি আটানব্বই বছর বেঁচে থাকার কথা ছিল। বেশ সমাদরের সঙ্গেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল। গল্পটিতে তাঁর চরিত্র সম্পর্কিত আর কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
১৩.মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ ছোটোগল্প অবলম্বন করে বড়োপিসিমার চরিত্র আলোচনা করো।
উত্তর বড়োপিসিমার চরিত্র:- মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ ছোটোগল্পের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হল বড়োপিসিমা। তাঁর প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
ঈশ্বরভত্তি:- বড়োপিসিমা হলেন এ গল্পে উল্লিখিত ‘বড়ো বাড়ির’ অবিবাহিতা,, প্রৌঢ়া কন্যা। প্রয়াত জ্যেষ্ঠ বুড়োকর্তার যখন স্ত্রীবিয়োগ ঘটে, তখন তিনি সংসার সামলানোর কারণেই তাঁর এই বিবাহযোগ্য কন্যার বিয়ে দেননি। বড়োপিসিমা পিতার এই সিদ্ধান্তে অবশ্য অখুশি ছিলেন না। তিনি শিবকেই পতি হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন।
১৪.মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ ছোটোগল্পে উচ্ছবের চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো ?
উত্তর দুর্ভাগ্যপীড়িত:- মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ ছোটোগল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র উৎসব নাইয়া নিম্নবর্গীয় সমাজব্যবস্থার একজন প্রতিনিধি। ভাগ্যের ফেরে মাতলার বন্যায় বউ-ছেলেমেয়েকে হারায় সে। ভেসে যায় তার মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকুও। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ উৎসবের জীবন থেকে সব কিছু কেড়ে নিলেও কেড়ে নিতে পারেনি তার আদিম প্রবৃত্তিকে, যে প্রবৃত্তির নাম খিদে। তাই প্রিয়জন হারানোর শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই তার মধ্যে জেগে ওঠে ভাতের জন্য হাহাকার।
মমতা ও ভালোবাসাপ্রিয়:- হাভাতে উৎসবের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসার আগে পর্যন্ত তার মধ্যেও কোমলতার স্পর্শ ছিল। তাই সতীশ মিস্তিরির তিন ধানে মড়ক লাগলে ধানের প্রতি পরম মমতায় কেঁদে ভাসায় এই গরিব ভাগচাষি। ভেসে যাওয়া ঘরের চালের নীচ থেকে পরিচিত স্বর শোনার আশায় নাওয়াখাওয়া ভুলে বসে থাকে উৎসব। অসম্ভব জেনেও পাগলের মতো বলতে থাকে, ‘রা কাড় অ চমুনীর মা।”
মানবিকতা:- পরম আকাঙ্ক্ষিত ভাতের স্পর্শে ‘প্রেত’ উচ্ছবের ভিতর থেকে জেগে ওঠে ‘মানুষ’ উৎসব। তাই বড়ো বাড়ি থেকে নিয়ে আসা ডেকচির ভাত খেতে খেতে সে মনে মনে সেই ভাত তুলে দেয় বউ-ছেলেমেয়ের মুখে… “চল্গুনী রে। তুইও খা, চলুনীর মা খাও, ছোটো খোকা খা, আমার মধ্যে বসে তোরাও খা।”
সর্বহারা বঞ্চিত:- আসলে উৎসবের মতো বঞ্চিত, প্রান্তিক মানুষদের সমাজজীবনে ব্যক্তিনামেরও কোনো মূল্য নেই। তাই আমরা দেখি তার নিরুৎসব জীবনে সে আর উৎসব থাকেনি, তার নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে উচ্ছব নাইয়া ।