Class 12 Bengali

মহুয়ার দেশ কবিতার বড় প্রশ্ন ও উত্তর

১.”মাঝে মাঝে সন্ধ্যার জলস্রোতে/অলস সূর্য দেয় এঁকে”- ‘অলস সূর্য’ কী এঁকে দেয়? মন্তব্যটি ব্যাখ্যা করো। এই দৃশ্য কবিচেতনায় কোন্ ভাবনার জন্ম দেয়?
১+২+২

উত্তর:- অঙ্কিত বিষয়:- কবি সমর সেনের ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতায় ‘অলস সূর্য’ সন্ধ্যার জলস্রোতে এঁকে দেয় গলিত সোনার মতো উজ্জ্বল আলোর স্তম্ভ।

মন্তব্যের ব্যাখ্যা:- সন্ধ্যার অস্তগামী সূর্য কবির কল্পনায় হয়েছে ‘অলস সূর্য’। কবির মনে হয়েছে দিনের অবসান যেন সূর্যের আলস্যকেই নিশ্চিত করেছে। নদীর জলে প্রতিফলিত সূর্যের রশ্মিকে কবির মনে হয়েছে গলিত সোনার মতো উজ্জ্বল আলোর স্তম্ভ। সূর্যের এই আলো যেন জলের অন্ধকারের ধুসর ফেনায় আগুন লাগিয়ে দেয়। এইভাবে নাগরিক জীবনের ধূলিধূসর পরিবেশেও অস্তগামী সূর্য সৌন্দর্যের মায়াময় আবেশ তৈরি করে।

কবির ভাবনা:- শহরজীবনে সৌন্দর্যের এই আবহ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সুবলক্লান্ত শহরে তাই ধোঁয়ার বঙ্কিম নিশ্বাস শীতের দুঃস্বপ্নের মতো ঘুরে-ফিরে আসে। আর এর সূত্র ধরেই কবির মন পৌঁছে যায় অনেক, অনেক দূরে মেঘমদির মহুয়ার দেশে। সেখানে পথের দু-ধারে ছায়া-ফেলা দেবদারুর দীর্ঘ রহস্য আর রাত্রের নির্জন নিঃসঙ্গতাকে আলোড়িত করা দূর সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস কবিকে আচ্ছন্ন করে রাখে। নগরজীবনে ক্লান্ত-অবসন্ন কবি কামনা করেন-“আমার ক্লান্তি র উপরে ঝরুক মহুয়া-ফুল,/নামুক মহুয়ার গন্ধ।”

২. “আর আগুন লাগে জলের অন্ধকারে ধূসর ফেনায়।”- কীসের কথা বলা হয়েছে? এর ফলে কী ঘটে? এই অবস্থায় কবি কীসের প্রত্যাশা করেন?
১+২+২

উত্তর:- উদ্দিষ্ট কথা:- সমর সেনের ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতায় প্রশ্নোদ্ভূত অংশে অস্তগামী সূর্যের কথা বলা হয়েছে। কবির কথায়, অলস সূর্য সন্ধ্যার জলস্রোতে যে ‘গলিত সোনার মতো উজ্জ্বল আলোর স্তম্ভ’ আঁকে, তারই আগুন লাগে জলের অন্ধকারে ধূসর ফেনায়।
▶ পরিণতি:- সন্ধ্যার জলস্রোতে অস্তগামী সূর্যের আলো তৈরি করে দেয় এক উজ্জ্বল স্বত্থতা। একদিকে সূর্যের বিদায়মুহূর্তে অন্ধকারের আগমন স্বত্থতা ডেকে আনে, অন্যদিকে তার রক্তিম আভা সৃষ্টি করে এক মায়াময় উজ্জ্বলতার। কিন্তু সেই মায়াময়তার আবেশ যেন ছিন্ন হয়ে যায় নাগরিক পরিবেশের প্রতিকূলতায়। শীতের দুঃস্বপ্নের মতো সেখানে ঘুরে-ফিরে আসে ধোঁয়ার বঙ্কিম নিশ্বাস। নগরজীবনের বিষাক্ত পরিবেশে খন্ডিত হয় সৌন্দর্যের বাতাবরণ।
▶ কবির প্রত্যাশা:- এই অবস্থায় কবির চেতনায় আসে অনেক দূরের মেঘমদির ‘মহুয়ার দেশ’। সেখানে সারাক্ষণ পথের দু-ধারে ছায়া ফেলে দেবদারুর দীর্ঘ রহস্য আর দূর সমুদ্রের গর্জন রাত্রের নির্জন নিঃসঙ্গতাকে আলোড়িত করে। সেই নির্মল প্রকৃতির সান্নিধ্যে কবি নাগরিক জীবনের অবসাদ থেকে মুক্তি চান। তাই কবি কামনা করেন-“আমার ক্লান্ডির উপরে ঝরুক মহুয়া- ফুল, নামুক মহুয়ার গন্ধ।” কবি চান তাঁর শরীরে মহুয়ার মাদকতা আবেশ ছড়াক, চেতনায় থাক মহুয়ার গন্ধ।

৩. “সেই উজ্জ্বল স্তন্দ্বতায়/ ধোঁয়ার বঙ্কিম নিঃশ্বাস ঘুরে ফিরে ঘরে আসে/শীতের দুঃস্বপ্নের মতো।”-মন্তব্যটির তাৎপর্য আলোচনা করো?

উত্তর:- তাৎপর্য:- কথামুখ:- সমর সেনের ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতা নগরজীবনের ধূসর পটভূমিতে শান্তির নিশ্চিত আশ্রয়-সন্ধানের কথাই তুলে ধরেছে। প্রকৃতির অসামান্য প্রকাশ:- এই নগরজীবনের চারপাশেও সূর্য অস্ত যাওয়ার সময়ে প্রকৃতির অসামান্য প্রকাশ ঘটে। সন্ধ্যার জলস্রোতে তখন অলস সূর্য এঁকে দেয় ‘গলিত সোনার মতো উজ্জ্বল আলোর স্তম্ভ’। জলের অন্ধকারে ধূসর ফেনায় অস্তগামী সূর্যের মৃদু আলো যেন আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে যায়।
সৌন্দর্যের স্থায়িত্ব:- কিন্তু নগরজীবনের ধূসর পরিবেশে এই সৌন্দর্য চিরস্থায়ী হয় না, অত্যন্ত ক্ষণিকের এই মায়াময় পরিবেশের পরেই সেখানে ঘুরে-ফিরে আসে বিষাক্ত ধোঁয়ার আবরণ। কবির কাছে তা ‘শীতের দুঃস্বপ্নের মতো’। এই নগরজীবনের ভয়াবহতা থেকে কবি মুক্তি চান।
মুক্তির সন্ধান:- এই মুক্তির সন্ধানেই কবি তাঁর চেতনার মধ্যে মহুয়ার দেশকে খোঁজেন। তিনি প্রার্থনা করেন-“আমার ক্লাপ্তির উপরে ঝরুক মহুয়া-ফুল।” কিন্তু এই প্রার্থনা তাঁর জীবনের বাস্তবতাকে পালটায় না। সর্বগ্রাসী যন্ত্রসভ্যতা মহুয়ার দেশেও প্রভাব ফেলে। শিশিরভেজা সকালে মানুষের শরীরে লেগে থাকে ধুলোর কলঙ্ক। ক্লান্ত দুঃস্বপ্ন ঘিরে থাকে তাদের।
শেষের কথা:- এভাবেই কবি ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতায় নাগরিক জীবনের বিবর্ণতা আর হতাশার ছবি তুলে ধরেছেন। কল্পনাবিলাস আর স্বপ্নময়তা এভাবেই বুক্ষ বাস্তবের আঘাতে বাধাপ্রাপ্ত হয়।

৪.”অনেক, অনেক দূরে আছে মেঘ-মদির মহুয়ার দেশ”-কবি ‘মহুয়ার দেশ’-এর কী বর্ণনা দিয়েছেন? এই ‘মহুয়ার দেশ’ কীভাবে কবির চেতনাকে প্রভাবিত করেছে, তা নিজের ভাষায় আলোচনা করো। ২+৩

উত্তর:- কবি প্রদত্ত মহুয়ার দেশের বর্ণনা:- অন্য একটি কবিতায় সমর সেন লিখেছিলেন- “বৃষ্টির আভাসে করুণ পথে ধুলো উড়ছে, এমন দিনে সে- ধুলো মনে শুধু আনে/সাঁওতাল পরগণার মেঘমদির আকাশ।” আলোচ্য কবিতাতেও দেখা যায় কবির কাছে ‘মহুয়ার দেশ’ হল ‘মেঘমদির’। সেখানে সবসময় পথের দু-পাশে ছায়া ফেলে রহস্যময় দেবদারু গাছেরা। রাত্রির নিঃসঙ্গ নির্জনতাকে আলোড়িত করে ‘দূর সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস’।
▶ কবির চেতনায় ‘মহুয়ার দেশ’:- অবসন্নতা থেকে মুক্তি: ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতায় কবি সমর সেন নগরজীবনের ক্লান্তিকর অবসন্নতা থেকে মুক্তি খোঁজেন। কবির চেতনায় আসে মেঘমদির সুদূর মহুয়ার দেশ। প্রকৃতির অনুষণ:- গ্রামজীবনের নির্মল প্রকৃতির অনুষঙ্গ হিসেবে কবির কল্পনায় মাদকতাময় মহুয়া ফুলের আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। যে কবি লিখেছিলেন- “একদা শালবনে কেটেছে রোমান্টিক দিন”, তাঁর কবিতায় ‘মহুয়ার দেশ’ হয়ে ওঠে বিবর্ণ শহরজীবনে ক্লান্ত মানুষের বেঁচে থাকার আশ্রয়। তাঁর ক্লান্তির উপরে মহুয়া ফুল ঝরে পড়ুক, “নামুক মহুয়ার গন্ধ” এটাই কবির আকাঙ্ক্ষা হয়ে ওঠে। যন্ত্রসভ্যতার বিপন্নতাই:- কিন্তু তাঁর স্বপ্নের মহুয়ার দেশেও হানা দেয় যন্ত্রসভ্যতা। কবির কানে আসে মহুয়া বনের ধারের কয়লাখনির প্রবল শব্দ, শিশিরভেজা সবুজ সকালেও কবি দেখতে পান মানুষের শরীরে লেগে-থাকা ধুলোর কলঙ্ক। নিদ্রাহীন এইসব মানুষের চোখে ভিড় করে আসা যন্ত্রসভ্যতার বিপন্নতাই কবির কাছে চূড়ান্ত সত্য হয়ে দেখা দেয়।

৫. “সমস্তক্ষণ সেখানে পথের দুধারে ছায়া ফেলে/দেবদারুর দীর্ঘ রহস্য”-কোন্ জায়গার কথা বলা হয়েছে? মন্তব্যটি ব্যাখ্যা করো। এ প্রসঙ্গে কবির মনোভাব কী?
১+২+২

উত্তর। উদ্দিষ্ট জায়গা:- সমর সেনের ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতার প্রশ্নোদৃত অংশে কবি অনেক অনেক দূরের ‘মহুয়ার দেশ’-এর কথা বলেছেন।

মন্তব্যের ব্যাখ্যা:- নাগরিক জীবনের ‘শীতের দুঃস্বপ্নের মতো’ ধোঁয়ার বিষাক্ত নিশ্বাস থেকে অনেক দূরে আছে কবিকল্পনার মেঘমদির মহুয়ার দেশ। প্রকৃতি সেখানে বাধাহীনভাবে নিজেকে মেলে দেয়। সেখানে পথের দু-ধারে যেমন দেবদারু গাছের ছায়া রহস্যময়তার সৃষ্টি করে, ঠিক তেমনই ‘দীর্ঘশ্বাস’-এর মতো দূর সমুদ্রের গর্জন রাতের নির্জন নিঃসঙ্গতাকে আলোড়িত করে। এভাবেই কবি নাগরিক জীবনের ক্লান্ডির বিপরীতে প্রকৃতির অবাধ উন্মোচনকে খুঁজে পান।
কবির মনোভাব:- ‘মহুয়ার দেশ’-এর সন্ধান: নাগরিক জীবনের অবসাদ ও ক্লান্ডির বিপরীতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে কবি সমর সেন এই ‘মহুয়ার দেশ’-এর সন্ধান করেছেন। প্রকৃতির মায়াময় আবেশ: অস্তগামী সূর্যের আলো সন্ধ্যার জলস্রোতে যখন গলিত সোনার মতো উজ্জ্বল স্বর্ণালি আভা রচনা করে, তখন সাময়িকভাবে শহরে প্রকৃতিতেও মায়াময় আবেশ তৈরি হয়। কিন্তু তা চিরস্থায়ী হয় না। নাগরিক জীবনের দূষণের বিষাক্ত ধোঁয়ার নিশ্বাসে সেই সৌন্দর্য হারিয়ে যায়। প্রিয়তম আশ্রয়স্থল: সেইসময় মহুয়ার দেশের শান্ত নির্মলতাকেই কবি আশ্রয় করতে চান। তিনি চান তাঁর ক্লান্তির উপরে ঝরুক মহুয়ার ফুল, আবেশ ছড়াক মহুয়ার গন্ধ। মহুয়ার দেশের সজীবতার স্পর্শে তিনি নিজেকে প্রাণবন্ত করে তুলতে চান। তাই নগরজীবন থেকে দূরবর্তী ‘মহুয়ার দেশ’ হয়ে ওঠে কবির আকাঙ্ক্ষিত প্রিয়তম আশ্রয়স্থল ।

৬.”আমার ক্লান্তির উপরে ঝরুক মহুয়া-ফুল,/নামুক মহুয়ার গন্ধ।”-‘আমার’ বলতে কার কথা বলা হয়েছে? এমন কামনার কারণ কী?
১+৪

উত্তর:- ‘আমার’ পরিচয়:- ‘আমার’ বলতে ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতার কবি সমর সেনের কথা বলা হয়েছে।
▶ কামনার কারণ: মুক্তির নিশ্বাস:- কবি সমর সেন নাগরিক ক্লান্ডি থেকে মুক্তির জন্য ‘মহুয়ার দেশ’-এর কথা ভেবেছেন। প্রকৃতির সেই বাধাহীন বিস্তারে, মেঘমদিরতায় কবি ‘শীতের দুঃস্বপ্নের মতো’ নগরজীবনের দূষণ ‘ধোঁয়ার বঙ্কিম নিঃশ্বাস’-কে ভুলে থাকতে চেয়েছেন। প্রকৃতির নির্মলতা: মহুয়ার দেশে পথের দু-ধারে ছায়া ফেলা দেবদারু গাছের রহস্যময়তা বা দূর সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাসরূপী গর্জন কবিকে আকৃষ্ট করে। প্রকৃতির এই নির্মলতাকে আশ্রয় করেই কবি নাগরিক অবসন্নতা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছেন। তাই হৃদয়ের গভীরতম আকাঙ্ক্ষায় তিনি উচ্চারণ করেন-“আমার ক্লান্ডির উপরে ঝরুক
মহুয়া-ফুল/নামুক মহুয়ার গন্ধ।” ইচ্ছাপূরণের অপূর্ণতা:- কিন্তু কবির এই ইচ্ছাপূরণের আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ থেকে যায়। নগরজীবনে বসে রাত্রির অসহ্য নিবিড় অন্ধকারে কবি শোনেন মহুয়া বনের ধারের কয়লাখনির গভীর বিশাল ।

৭.”ঘুমহীন তাদের চোখে হানা দেয়/কীসের ক্লান্ত দুঃস্বপ্ন।” মন্তব্যটির প্রেক্ষাপট আলোচনা করো?

উত্তর:- মন্তব্যের প্রেক্ষাপট:- কথামুখ:- সমর সেন তাঁর ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতায় নগরজীবনের ধূসরতা ও যান্ত্রিকতায় ক্লান্ত মানুষের যন্ত্রণাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রকৃতির রহস্যময়তা: প্রকৃতির নির্মল পটভূমিকে এখানে বিবর্ণ করে দেয় ‘ধোঁয়ার বঙ্কিম নিঃশ্বাস’। এখান থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই কবিকে আকর্ষণ করে মেঘমদির মহুয়ার দেশ, যেখানে পথের দু-পাশে ছায়া ফেলে রহস্যময় দেবদারু গাছের সারি। কবি আকাঙ্ক্ষা করেন যে, তাঁর ক্লান্ডির উপরে ঝরুক মহুয়া ফুল। তাঁর চেতনায় ছড়াক স্নিগ্ধ আবেশ। যন্ত্রসভ্যতার বিপন্নতা: কিছু নগরজীবনের সর্বগ্রাসী যান্ত্রিকতায় তার কোনো সন্ধানই পান না কবি। বরং তাঁর কানে আসে মহুয়া বনের ধারে কয়লাখনির প্রবল শব্দ। শিশিরে ভেজা সবুজ সকালেও মহুয়ার দেশের অবসন্ন মানুষদের শরীরে লেগে থাকে ধূলোর কলঙ্ক। তাদের ঘুমহীন চোখে আজও ক্লান্ত দুঃস্বপ্ন জেগে থাকে। ‘কীসের’ শব্দটি উল্লেখের দ্বারা কবি অনিশ্চয়তাকে বোঝাতে চাইলেও এটা স্পষ্ট যে, তাঁর স্বপ্নের মহুয়ার দেশও আজ যন্ত্রসভ্যতার শিকার। আর তারই বিপন্নতা হানা দেয় সেখানকার মানুষদের দুঃস্বপ্নে। মুক্তিহীন জীবন: যন্ত্রসভ্যতার ক্ষয়, বিকৃতি আর যান্ত্রিকতার ক্লান্ডি থেকে মুক্তি পায় না স্বপ্নের মহুয়ার দেশও। সেই পরিত্রাণহীন জীবনকেই সমর সেন তাঁর ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতায় তুলে ধরেছেন ।

৮. ঘুমহীন তাদের চোখে হানা দেয়/কিসের ক্লান্ত দুঃস্বপ্ন।” -কাদের কথা বলা হয়েছে? তাদের ঘুমহীন চোখে ক্লান্ত দুঃস্বপ্ন হানা দেয় কেন? ১+৪

উত্তর উদ্দিষ্ট ব্যক্তিসমূহ:- সমর সেনের ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতা থেকে উদ্ধৃত এই উক্তিটিতে মহুয়ার দেশের কয়লাখনির অবসন্ন শ্রমিকদের কথা বলা হয়েছে।
▶ ঘুমহীন চোখে ক্লান্ত দুঃস্বপ্নের হানা দেওয়ার কারণ:- নগরজীবন থেকে মুক্তি:- সমর সেন তাঁর ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতায় নগরজীবনের ধূসরতা ও যান্ত্রিকতায় ক্লান্ত মানুষের যন্ত্রণাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। এখান থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই কবিকে আকর্ষণ করে মেঘমদির মহুয়ার দেশ, যেখানে পথের দু-পাশে ছায়া ফেলে রহস্যময় দেবদারু গাছের সারি। প্রকৃতির বুকে যন্ত্রসভ্যতা: কবি আকাঙ্ক্ষা করেন যে, তাঁর ক্লান্ডির উপরে মহুয়া ফুল ঝরে পড়ুক। তাঁর চেতনায় ছড়াক স্নিগ্ধ আবেশ। কিন্তু এখানকার সর্বগ্রাসী যান্ত্রিকতায় তার কোনো সন্ধানই পান না কবি। বরং তাঁর কানে আসে মহুয়া বনের ধারে কয়লাখনির প্রবল শব্দ। শিশিরে ভেজা সবুজ সকালে মহুয়ার দেশের অবসন্ন মানুষদের শরীরেও লেগে থাকে ধুলোর কলঙ্ক। তাঁর স্বপ্নের মহুয়ার দেশও যে আজ যন্ত্রসভ্যতার শিকার। আর তারই বিপন্নতা হানা দেয় সেখানকার মানুষদের দুঃস্বপ্নে। যন্ত্রসভ্যতার ক্ষয়, বিকৃতি আর যান্ত্রিকতার ক্লান্ডি থেকে মুক্তি পায় না, স্বপ্নের মহুয়ার দেশও। একারণেই তাদের ঘুমহীন চোখে ক্লান্ড দুঃস্বপ্ন হানা দেয়।

৯.”অবসন্ন মানুষের শরীরে দেখি ধুলোর কলঙ্ক”-এখানে কোন্ মানুষের কথা বলা হয়েছে? তাঁরা অবসন্ন কেন? ‘ধুলোর কলঙ্ক’ বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন? ১+২+২

উত্তর:- সমর সেনের ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতার উল্লিখিত অংশে কবির প্রিয় মহুয়ার দেশের মানুষদের কথা বলা হয়েছে। মহুয়ার দেশ কবির কাছে নাগরিক সভ্যতার দূষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র আশ্রয়। ‘মেঘ-মদির’ মহুয়ার দেশ, পথের দু-ধারে দেবদারু বনের রহস্যময়তা, রাত্রের নির্জনতা, আলোড়িত করা সমুদ্রের গর্জন কবিকে মুগ্ধ করে। নাগরিক ক্লান্ডিতে মহুয়ার দেশকেই কবি নিজের আশ্রয় ভাবেন। কিন্তু সেই মহুয়ার দেশেও যন্ত্রসভ্যতার আগ্রাসন কবি লক্ষ করেন। কয়লাখনির শব্দ প্রকৃতির নির্মল বিস্তারে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কঠিন শ্রম আর তার একঘেয়েমি অবসন্ন করে রাখে মানুষদের।
‘ধুলোর কলঙ্ক’ এখানে দূষণের প্রতীক। প্রকৃতির সহজ বিস্তারের মধ্যে কীভাবে যন্ত্রসভ্যতা তাকে মলিন করে তুলেছে তা বোঝাতেই শব্দবন্ধটি ব্যবহার করা হয়েছে। কয়লাখনি যন্ত্রসভ্যতার প্রতীক হয়ে এসেছে মহুয়ার দেশে। আর তার সৃষ্ট দূষণের ইঙ্গিত নিয়ে এসেছে ‘ধুলোর কলঙ্ক’; যা নিদ্রাহীন মহুয়ার দেশের মানুষদের চোখে ‘ক্লান্ত দুঃস্বপ্ন’ তৈরি করে দিয়েছে।

১০.’মহুয়ার দেশ’ কবিতার মূল বক্তব্য সংক্ষেপে আলোচনা করো।

উত্তর সূচনা:- নগরজীবন ও তার যান্ত্রিকতা, প্রাণহীনতা, ভণ্ডামি ইত্যাদি বারবার সমর সেনের কবিতার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। “তিলে তিলে মৃত্যু বুদ্ধশ্বাস মৃত্যু আমাদের প্রাণ/দিকে দিকে আজ হানা দেয় বর্বর নগর”- এটাই ছিল কবি সমর সেনের উপলব্ধি। নগরজীবনের কথা:- ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতাতেও এই নগরজীবনই পটভূমি হিসেবে উঠে এসেছে। যখন সন্ধ্যার জলস্রোতে অলস সূর্য এঁকে দেয় ‘গলিত সোনার মতো উজ্জ্বল আলোর স্তম্ভ’ তখনই নগরজীবনে সেই উজ্জ্বল স্বত্থতার মধ্যে “ধোঁয়ার বঙ্কিম নিঃশ্বাস ঘুরে ফিরে ঘরে আসে/শীতের দুঃস্বপ্নের মতো।” মুক্তির ইচ্ছা: নগরজীবনের এই ক্লান্তি থেকে মুক্তির জন্যই কবি যেতে চেয়েছেন অনেক দুরের মেঘমদির মহুয়ার দেশে, যেখানে পথের দু-ধারে সমস্তক্ষণ ছায়া ফেলে ‘দেবদারুর দীর্ঘ রহস্য’। কবি চান, মহুয়া ফুলের মাদকতাময় গন্ধে তাঁর যাবতীয় ক্লান্ডি মুছে যাক। প্রকৃতির বুকে যন্ত্রসভ্যতা: কিন্তু তার বদলে মহুয়া বনের ধারের কয়লাখনির প্রবল শব্দই শুধু শোনা যায়। শিশিরে ভেজা সবুজ, সতেজ সকালেও অবসন্ন মানুষদের শরীরে ধূলোর কলঙ্ক লেগে থাকে। ঘুমহীন সেইসব মানুষের চোখে ক্লান্ত দুঃস্বপ্নই একমাত্র সত্য হয়ে হানা দেয়। অর্থাৎ নগরজীবন থেকে কবি কোনোভাবেই মুক্ত হতে পারেন না। কবিচেতনায় নগরজীবনের প্রভাব: ‘মহুয়ার দেশ’-কে নিয়ে ভাবতে গিয়েও যন্ত্রসভ্যতাই তাঁর চেতনাকে অধিকার করে নেয়। নগরজীবনের ক্লান্ডি আর বিবর্ণতাকে এভাবেই কবি তাঁর ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতায় ধরে রাখেন।

১১.’মহুয়ার দেশ’ কবিতায় কবি নগরজীবনের যে ছবি তুলে ধরেছেন তা নিজের ভাষায় আলোচনা করো।

উত্তর নগরজীবনের ছবি:- প্রাক্কথন:- সমর সেনের ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতাটি নগরজীবনের ক্লান্তি, বিষণ্ণতা আর কৃত্রিমতা নিয়ে কবির অনুভবের প্রকাশ। এখানে সন্ধ্যার চিরন্তন অনাবিল পটভূমিতে ‘ধোঁয়ার বঙ্কিম নিঃশ্বাস’ ঘুরে-ফিরে আসে। এই আসা কবির কাছে একেবারেই কাম্য নয়, তাই তা শীতের দুঃস্বপ্নের মতোই মনে হয়। ক্লান্তি থেকে মুক্তি: এই নাগরিক ক্লান্ডি থেকে মুক্তির জন্য কবির চেতনা জুড়ে থাকে মহুয়ার দেশ, যা রাত্রির নির্জন নিঃসঙ্গতাকেও আলোড়িত করে। কবি চান তাঁর ক্লান্ডির ওপরে ঝরুক মহুয়া ফুল, আবেশ ছড়াক তার মাদকতাময় গন্ধ। প্রকৃতির কোলে যন্ত্রসভ্যতার ধ্বনি: কিন্তু নগরজীবন এই রোমান্টিক ভাবনাকে প্রশ্রয় দেয় না। তাই নাগরিক জীবনের প্রবল কোলাহলের মধ্যে কবি শেষপর্যন্ত শুধু মহুয়ার দেশের কয়লাখনির প্রবল আওয়াজটুকুই পান, পান না কোনো স্নিগ্ধতা অথবা নির্মলতা, পান না দেবদারু গাছের দীর্ঘ রহস্যময় ক্লান্ডিদূরকারী ছায়া। শিশির-আখা সবুজ সকালেও তাই তাঁর চোখে ভেসে ওঠে মহুয়ার দেশের মানুষদের ধুলোর কলঙ্কমাখা অবসন্ন মুখ। অপূর্ণ সাধ: কবি প্রত্যক্ষ করেন, নাগরিক পৃথিবীর ক্লান্ডি, ক্ষয়, সংকট ও বিপন্নতার হাত থেকে ‘মেঘ-মদির মহুয়ার দেশ’ও মুক্তি পায় না। প্রকৃতপক্ষে ‘মহুয়ার দেশ’-এর কবি যেন শহরে নির্বাসিত এক যক্ষ। সবুজ প্রকৃতির রূপে এবং তার মদির সুগন্ধে তিনি মোহিত হতে চান, ভুলতে চান ‘রাত্রের নির্জন নিঃসঙ্গতাকে’। কিন্তু তাঁর সাধ অপূর্ণ থেকে যায়। শেষের কথা: গ্রাম আজ আর গ্রাম নেই, নগরজীবন তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। তাই কবি নগরজীবনের এই সর্বগ্রাসী চেহারাকে তুলে ধরেন এই কবিতায় ।

১২.সমর সেনের ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতাটির রচনাশৈলীর বিশিষ্টতা আলোচনা করো।

উত্তর কবির রচনাশৈলী:- বক্তব্যের উপস্থাপনা: সমর সেন তাঁর একটি কবিতায় লিখেছিলেন-“কালক্রমে টেকনিক নিয়ে যাবে নব্যকাব্যলোকে।” সমর সেনের কবিতার আঙ্গিকের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল সংক্ষিপ্ত আয়তনে গম্ভীর বক্তব্যকে তুলে ধরা। এই বিশেষত্ব ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতাতেও প্রকাশ পায়। মাত্র বাইশটি পত্তিতে কবি নগরজীবনের ক্লান্তি আর শূন্যতাকে তুলে ধরেন, সঙ্গে থাকে এক আশ্চর্য রোমান্টিকতা-যা এই ক্লান্ত জীবনের বহু আকাঙ্ক্ষিত রোমান্টিকতা হিসেবে উঠে আসে। কাব্যিক শব্দের প্রয়োগ: বিষয়কে তুলে ধরার ক্ষেত্রে ভাষা হয়ে ওঠে কবির অস্ত্র। মাঝেমধ্যে তির্যক কথ্য শব্দের ব্যবহার, সমর সেনের রচনাশৈলীর বৈশিষ্ট্য হলেও ‘মহুয়ার দেশ’-এ সেই ধরন নেই। পরিবর্তে রয়েছে কাব্যিক শব্দের প্রয়োগ। চিত্রকল্পের ব্যবহার: চিত্রকল্পগুলি ভাষার এবং বর্ণনার সহজতার কারণে নিটোল হয়ে ওঠে। “মাঝে মাঝে সন্ধ্যার জলস্রোতে/অলস সূর্য দেয় এঁকে/গলিত সোনার মতো উজ্জ্বল আলোর স্তম্ভ”-সাধ্য প্রকৃতির একটা গোটা ছবিকে তার রং-সহ এভাবেই এঁকে দেন সমর সেন। ‘অলস সূর্য’, ‘উজ্জ্বল স্বপ্নতা’, ‘মেঘ-মদির মহুয়ার দেশ’ শব্দবন্ধগুলি তৈরি করে দেয় অপরূপ কাব্যময়তা। ব্যঞ্জনধর্মিতা: আবার যন্ত্রসভ্যতার ক্লান্ডিকে বোঝাতে কবি যখন লেখেন- “ঘুমহীন তাদের চোখে হানা দেয়/কীসের ক্লান্ত দুঃস্বপ্ন।” ক্লান্ডির ব্যঞ্জনা যেন সীমাহীন হয়ে যায়। এভাবেই সমগ্র কবিতাটি কবির সৃষ্টিশীলতার অসামান্য উদাহরণ হয়ে থাকে।

১৩. ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতায় কবি মহুয়ার দেশের যে চিত্র অঙ্কন করেছেন তার পরিচয় দাও।

উত্তর:- মহুয়ার দেশের চিত্র:- ভূমিকা:- সমর সেনের ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতাটি নাগরিক জীবনের যান্ত্রিকতা আর একঘেয়েমিতে ক্লান্ত কবির আশ্রয়- সন্ধানের কথাই তুলে ধরে। প্রান্তিক ভূখণ্ডের ছবি:- কোলাহলমুখর জনজীবনের বাইরে প্রান্তিক ভূখণ্ড মহুয়ার দেশই কবির কাছে সেই আশ্রয়। যখন ‘ধোঁয়ার বঙ্কিম নিঃশ্বাস’ ‘শীতের দুঃস্বপ্নের মতো’ কবিকে তাড়া করে, তখনই কবির চেতনাকে অধিকার করে মেঘমদির মহুয়ার দেশ। প্রকৃতির অবাধ বিচরণ: নাগরিক ক্লান্ডি, বিবর্ণতা আর দূষণকে অতিক্রম করে প্রকৃতি সেখানে অবাধে নিজেকে মেলে দিয়েছে। সমস্তক্ষণ পথের দু-ধারে সেখানে ছায়াময় হয়ে থাকে দেবদারুর ‘দীর্ঘ রহস্য’। অরণ্যের নিবিড়তা এই রহস্যময়তার জন্ম দেয়। আগ্রাসী নগরসভ্যতায়, যেখানে সবই অনাবৃত সেখানে এই রহস্যের খোঁজ পাওয়া যায় না। স্বপ্নকল্পনার আশ্রয়স্থল: মহুয়ার দেশে দূর সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাসে রাত্রের নির্জন নিঃসঙ্গতা আলোড়িত হয়। প্রকৃতি যেখানে আপন স্বভাবে নিজেকে মেলে দেয়-মহুয়ার দেশ তার পটভূমি। নাগরিক ক্লান্তিতে বিপন্ন কবির স্বপ্নকল্পনার আশ্রয় এই মহুয়ার দেশ। তাই তাঁর আকাঙ্ক্ষা হয়- “আমার ক্লান্তির উপরে ঝরুক মহুয়া ফুল/নামুক মহুয়ার গন্ধ।” যন্ত্রসভ্যতার গ্রাস:- যদিও কবির এই প্রিয় আকাঙ্ক্ষা দীর্ঘস্থায়ী হয় না, যন্ত্রসভ্যতা ক্রমশ গ্রাস করে সুন্দর প্রকৃতিকে। মহুয়ার দেশেও তাই শোনা যায় কয়লাখনির শব্দ, দেখা যায় দুঃস্বপ্নপীড়িত অবসন্ন মানুষের মুখ। তবুও ‘মহুয়ার দেশ’ হয়ে থাকে কবিচেতনার এক গভীরতম, তীব্রতম আকাঙ্ক্ষা।

You may also like

উচ্চমাধ্যমিক বাংলা কে বাঁচায় কে বাঁচে (গল্প) মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন ও উত্তর
Class 12 Bengali

উচ্চমাধ্যমিক বাংলা কে বাঁচায় কে বাঁচে (গল্প) মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন ও উত্তর

1. “কে বাঁচায় কে বাঁচে” গল্পটি প্রথম কোন্ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়? – ক) কালিকলম খ) পুঁথিপত্র গ) ভৈরব ঘ) মহামন্বন্তর
উচ্চমাধ্যমিক বাংলা ভাত (গল্প) মহাশ্বেতা দেবী প্রশ্ন ও উত্তর
Class 12 Bengali

উচ্চমাধ্যমিক বাংলা ভাত (গল্প) মহাশ্বেতা দেবী প্রশ্ন ও উত্তর

১) “ উনি হলেন দেবতার সেবিকা। ” – ‘ উনি ‘ বলতে কার কথা বােঝানাে হয়েছে? ক) বড়াে বউ খ)