Madhyamik history

মাধ্যমিক ইতিহাস সপ্তম অধ্যায় বিশ শতকের ভারতে নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী প্রশ্ন মান – ৮ প্রশ্ন ও উত্তর

মাধ্যমিক ইতিহাস সপ্তম অধ্যায় বিশ শতকের ভারতে নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী প্রশ্ন মান - ৮ প্রশ্ন ও উত্তর

(1) * বাংলায় সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের বিবরণ দাও।

উত্তর:-বাংলায় সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন

ভূমিকা: বিংশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলা ভারতের ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এই সময় বিভিন্ন গুপ্তসমিতির প্রতিষ্ঠা, বিপ্লবীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ, বৈপ্লবিক কার্যকলাপ শুরু হয়।

[1] অনুশীলন সমিতি: বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলনের প্রসারের ক্ষেত্রে অনুশীলন সমিতি সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। বিপ্লবী সতীশচন্দ্র বসুর উদ্যোগে এবং ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র (পি মিত্র)-র সহায়তায় ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার মদন মিত্র লেনে অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে সদস্যদের কুস্তি, শরীরচর্চা, চরিত্র গঠন প্রভৃতির সঙ্গে গোপনে বিপ্লবী কাজকর্ম চলত। অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, চিত্তরঞ্জন দাশ প্রমুখ এই সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, রাজশাহি, চট্টগ্রাম, রংপুর প্রভৃতি জেলায় এই সমিতির শাখা গড়ে ওঠে। বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাসের উদ্যোগে ঢাকার অনুশীলন সমিতির কার্যকলাপ যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।

[2] যুগান্তর দল ও অন্যান্য সমিতি: বিপ্লবী ভাবধারা প্রচারের উদ্দেশ্যে বারীন ঘোষ ও উপেন্দ্রনাথ ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ‘যুগান্তর’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে যুগান্তর দল গঠিত হয়। এই দলের সদস্যরা পূর্ববঙ্গ ও আসামের অত্যাচারী ছোটোলাট ব্যামফিল্ড ফুলার ও বাংলার গভর্নর অ্যান্ড্রু ফ্রেজারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। যুগান্তর দলের সদস্যরা ঢাকার প্রাক্তন ম্যাজিস্ট্রেট মি. অ্যালেনকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। যুগান্তর দল ছাড়াও এই সময় বাংলায় আত্মোন্নতি সমিতি, ব্রতী সমিতি, সুহৃদ সমিতি প্রভৃতি বিপ্লবী কার্যকলাপ চালিয়ে যায়।

3] কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টা: যুগান্তর দলের সদস্য ক্ষুদিরাম [

বসু ও প্রফুল্ল চাকি কলকাতার অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে কিংসফোর্ড মুজফফরপুর বদলি হয়ে গেলে ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল মজফফরপুর চলে যান। সেখানে তাঁরা কিংসফোর্ডকে মারতে গিয়ে ভুলবশত বোমার আঘাতে মিসেস কেনেডি ও তাঁর কন্যা মিস কেনেডি নামে দুজন নিরপরাধ মহিলাকে হত্যা করেন। এই ঘটনার পর প্রফুল্ল চাকি আত্মহত্যা করলেও ক্ষুদিরাম ধরা পড়েন। আলিপুর

বোমার মামলার রায়ে তাঁর ফাঁসি হয়। [

4] ব্রিটিশ অফিসারদের হত্যা: বাংলার বিপ্লবীরা বিভিন্ন অত্যাচারী

ব্রিটিশ অফিসার এবং তাদের সহযোগী ভারতীয়দের হত্যার পরিকল্পনা করেন। [1] আলিপুর বোমার মামলার সরকারি উকিল আশুতোষ বিশ্বাস বিপ্লবীদের গুলিতে নিহত হন। [ii] ডেপুটি পুলিশ সুপার সামসুল আলম হাইকোর্টেই বিপ্লবীদের হাতে প্রাণ হারান। [iii] ক্ষুদিরাম বসুকে ধরিয়ে দেওয়ার অপরাধে বিপ্লবীরা পুলিশ অফিসার নন্দলাল ব্যানার্জি-কে হত্যা করেন।

[5] বুড়িবালামের যুদ্ধ: সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করে

বাঘাযতীন জার্মানি থেকে তিনটি অস্ত্রবোঝাই জাহাজ বাংলায় আনার ব্যবস্থা করেন। উড়িষ্যার বালেশ্বরে আগত মাভেরিক জাহাজের অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বাঘাযতীন, চিত্তপ্রিয়, মনোরঞ্জন, নীরেন, জ্যোতিষ প্রমুখ বালেশ্বরে পৌঁছোন। কিন্তু গোপন খবর পেয়ে পুলিশ কমিশনার টেগার্ট বিপ্লবীদের ঘিরে ফেললে বুড়িবালাম নদীর তীরে পুলিশ ও বিপ্লবীদের মধ্যে ব্যাপক গুলির লড়াই চলে। চিত্তপ্রিয় যুদ্ধক্ষেত্রে এবং পরে গুরুতর আহত বাঘাযতীন হাসপাতালে মারা যান। অন্য কয়েকজনের ফাঁসি অথবা কারাদণ্ড হয়।

6] চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন: মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে একদল [বিপ্লবী ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের সরকারি অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করেন। এই অভিযানে সূর্য সেনের সহযোগী ছিলেন নির্মল: সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত প্রমুখ বিপ্লবী। লুণ্ঠিত অস্ত্র নিয়ে বিপ্লবীরা জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেন। এখানে পুলিশের সঙ্গে তুমুল গুলির লড়াইয়ে ব্রিটিশ বাহিনীর ৭০ থেকে ১০০ জন এবং বিপ্লবীদের ১২ জনের মৃত্যু হয়। পরে অবশ্য সূর্য সেন ধরা পড়লে বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।

[7] অলিন্দ যুদ্ধ: বিপ্লবী বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান করে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করলে কুখ্যাত কারা অধিকর্তা সিম্পসন নিহত হন। এই ঘটনা ‘অলিন্দ যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। বাদল পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। বিনয় এবং দীনেশ গুলিতে আত্মহত্যার চেষ্টা করে আহত হন। পরে বিনয় হাসপাতালে মারা যান এবং দীনেশের ফাঁসি হয়।

[ ৪] ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ: প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে

শান্তি চক্রবর্তী, কালীকিঙ্কর দে প্রমুখ সশস্ত্র বিপ্লবীদের একটি দল ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের পাহাড়তলির ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ করে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশও পালটা আক্রমণ চালালে গ্রেফতার হওয়ার আগেই প্রীতিলতা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন।

[9] অন্যান্যদের ভূমিকা: গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসন কলিকাতা

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে শুরু করলে (১৯৩২ খ্রি.) বিপ্লবী বীণা দাস তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালান যদিও তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। বিপ্লবী কল্পনা দত্ত কলকাতা থেকে বিস্ফোরক এনে আদালতে বিস্ফোরণের উদ্যোগ নেন।

উপসংহার:- ভারতের মুক্তি সংগ্রামে বাংলার বিপ্লবীদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ সম্পূর্ণ বিফলে যায়নি। বিপ্লবী কার্যকলাপ যে ব্রিটিশদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই।

(2). “মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবী জীবন সম্পর্কে আলোচনা উত্তর করো।

সূর্য সেন:-

ভূমিকা:- মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন এমনই একজন ব্যক্তি যিনি সংসারের মায়াজালে নিজেকে বন্দি না রেখে দেশমাতার উদ্দেশ্যে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন।

[1] বিপ্লববাদে আগ্রহ: সূর্য সেন বহরমপুর কৃয়নাথ কলেজ থেকে

বি এ পাস করার পর চট্টগ্রামে ফিরে গিয়ে বিপ্লবী দল গঠনের উদ্যোগ নেন। এই সময় তাঁর সহযোগীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অম্বিকা চক্রবর্তী, নগেন্দ্রনাথ সেন, চারুবিকাশ দত্ত, অনুরূপ সেন, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ প্রমুখ। তাঁদের নিয়ে সূর্য সেন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি নামে সশস্ত্র বিপ্লবী দল গড়ে তোলেন।

[2] নাগরখানা পাহাড়ের যুদ্ধ: রেল শ্রমিকদের বেতন নিয়ে যাওয়ার সময় সূর্য সেনের গুপ্তসমিতির সদস্যরা ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে (১৩ ডিসেম্বর) বেতনের ১৭ হাজার টাকা ছিনতাই করে। প্রায় ২ সপ্তাহ পর গোপন খবর পেয়ে পুলিশ নাগরখানা পাহাড়ে বিপ্লবীদের আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয়। সূর্য সেন ও অম্বিকা চক্রবর্তী গ্রেফতার হন। অবশ্য পরে তাঁরা মামলা থেকে নিষ্কৃতি পান।

[3] টেগার্টকে হত্যার পরিকল্পনা: বিপ্লবীরা কলকাতার পুলিশ কমিশনার অত্যাচারী টেগার্ট সাহেবকে হত্যার পরিকল্পনা, করেন।. এফএই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেলে সূর্য সেনের বেশ কয়েকজন সী সহযোগী ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ধরা পড়ে যান কিন্তু সূর্য সেন পালাতে সক্ষম হন। অবশ্য ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে সূর্য সেন ধরা পড়েন এবং ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জেলে বন্দি থাকেন।

[4] চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন: সূর্য সেনের নেতৃত্বে গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, অনন্ত সিংহ-সহ ৬৫ জন সশস্ত্র বিপ্লবী চারটি উপদলে বিভক্ত হয়ে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ এপ্রিল রাত দশটায় চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণ করেন ও অস্ত্র লুঠ করেন। তাঁরা অস্ত্রাগারটিতে আগুন ধরিয়ে দেন। এরপর বিপ্লবীরা টেলিগ্রাম ও টেলিফোন অফিস আক্রমণ করে এবং পুলিশ ব্যারাক দখল করে নেয়। সূর্য সেন অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করেন। ১৮ থেকে ২১ এপ্রিল-এই চারদিন চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসনের অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্ত ছিল। ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন যে, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনাই হল ‘ভারতের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে সাহসিকতাপূর্ণ কাজ’।

[5] জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধ: অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর বিপ্লবীরা নিকটবর্তী জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেন। এই সময় সশস্ত্র ইংরেজ সেনা তাঁদের আক্রমণ করে। দুই ঘণ্টার তুমুল যুদ্ধে ১২ জন বিপ্লবী এবং ৭০ থেকে ১০০ জন ব্রিটিশ সেনা নিহত হয়। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সূর্য সেন পালাতে সক্ষম হন।

[6] মামলা: বিপ্লবীদের খোঁজে পুলিশ চারদিকে ব্যাপক তল্লাশি শুরু করে, ফলে বিপ্লবী ধরা পড়েন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে তাঁদের নিয়ে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলা শুরু হলে সূর্য সেন মাইন ব্যবহার করে জেলের প্রাচীর উড়িয়ে দিয়ে বন্দিদের মুক্ত করার এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। নেত্র সেন নামে জনৈক বিশ্বাসঘাতকের সহায়তায় ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে পুলিশ সূর্য সেনকে গ্রেফতার করে।

[7] পরিণতি: শেষপর্যন্ত মামলায় সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির আদেশ হয়। অনন্ত সিং, লোকনাথ বল, গণেশ ঘোষ-সহ ১২ বিপ্লবীর দ্বীপান্তর হয়। জেলবন্দি সূর্য সেনের ওপর অকথ্য শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। তাঁর দাঁত ও হাড় ভেঙে দেওয়া হয়। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি তাঁদের ফাঁসি কার্যকর হয়। তাঁর মৃতদেহ বহু দূরে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়।

উপসংহার: দেশমাতার মুক্তির উদ্দেশ্যে বাংলার প্রতিভাবান যুবকরা যেভাবে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিল তা স্বাধীন ভারতবর্ষকে মহিমান্বিত করেছে। তাঁদের নিয়েই স্বাধীন ভারতে সংগীত রচিত হয়েছে-“মাগো, আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে, তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি,… আমরা চিরদিনই হাসি মুখে মরতে জানি…।”

(3). বিনয়, বাদল ও দীনেশের বৈপ্লবিক কার্যকলাপের বিবরণ দাও। অথবা, অলিন্দ যুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা করো।

উত্তর:-বিনয়-বাদল-দীনেশ/অলিন্দ যুদ্ধ:-

ভূমিকা: সুভাষচন্দ্র বসুর উদ্যোগে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স (বি ভি) নামে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে ওঠে। এই বাহিনীর অন্যতম সদস্য ছিলেন বিনয় কৃয় বসু, বাদল গুপ্ত এবং দীনেশ গুপ্ত। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর তাঁরা কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করেন। এই ঘটনা অলিন্দ যুদ্ধ নামে পরিচিত।]

লোম্যান হত্যা:- মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র [1]বিনয় বসু বাংলার অত্যাচারী পুলিশ ইনস্পেকটর লোম্যান এবং ঢাকার পুলিশ সুপার হাডসনকে লক্ষ করে গুলি চালালে লোম্যানের মৃত্যু (১৯৩০ খ্রি.) হয়। ঘটনার পর বিনয় গা ঢাকা দেন। লোম্যান হত্যাকান্ডের পর যুবকদের ওপর পুলিশি অত্যাচার চরমে ওঠে।

[2] সিম্পসনকে হত্যার পরিকল্পনা: ইতিমধ্যে কারা বিভাগের ইনস্পেকটর জেনারেল কর্ণেল সিম্পসনের উদ্যোগে আলিপুর জেলে বন্দি সুভাষচন্দ্র-সহ বিভিন্ন নেতার ওপর চরম শারীরিক নির্যাতন শুরু হয়। ফলে বিনয় বসু সিম্পসনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। সিম্পসন রাইটার্স বিল্ডিং-এ তার দফতরে বসতেন। এজন্য বিনয় বসু রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করে সিম্পসনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

[3] অভিযান: বিপ্লবী বিনয় বসুর নেতৃত্বে বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ৮ ডিসেম্বর দুপুর ১২টায় কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করে। অসংখ্য পুলিশের প্রহরা অতিক্রম করে তাঁরা নিমেষে সিম্পসনের দফতরের সামনে চলে যান এবং সিম্পসনের সহকারী জ্ঞান গুহকে ঠেলে দফতরে ঢুকে পড়েন যেখানে সিম্পসন কর্মরত। বিনয় মুহূর্তের মধ্যে বলে উঠলেন, “প্রে টু গড কর্নেল। ইওর লাস্ট আওয়ার হ্যাস কাম।” সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবীদের পিস্তলের ৬টি গুলি সিম্পসনের দেহ বিদীর্ণ করে দেয় এবং দেহটি মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে।’

[4] অলিন্দ যুদ্ধ: বিপ্লবীরা পালাতে গেলে পুলিশ কমিশনার টেগার্টের নেতৃত্বে বিশাল পুলিশবাহিনী তাঁদের ঘিরে পালটা আক্রমণ চালায়। বিপ্লবীরাও গুলি চালাতে থাকে। দীনেশ গুলিবিদ্ধ হয়েও লড়াই চালিয়ে যান। রাইটার্স বিল্ডিং-এর বারান্দায় সংঘটিত উভয় পক্ষের এই লড়াই ‘অলিন্দ যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।

[5] মৃত্যু: বিপ্লবীদের গুলি ফুরিয়ে এলে তারা রাইটার্স বিল্ডিং-এর একটি ফাঁকা ঘরে ঢোকেন। সেখানে বাদল পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। বিনয় ও দীনেশ নিজেদের রিভলভারের শেষ দুটি গুলি নিজেদের মস্তিষ্কে চালিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পরে হাসপাতালে বিনয় নিজের মস্তিষ্কের ক্ষতস্থানে আঙুল চালিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। চিকিৎসায় দীনেশ সুস্থ হয়ে ওঠার পর তাঁর ফাঁসি হয়।

উপসংহার: বিনয়-বাদল-দীনেশের সীমাহীন দুঃসাহস ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বিরল। অলিন্দ যুদ্ধের ঘটনা ভারতের ব্রিটিশ শাসকদের মনে গভীর আতঙ্কের সৃষ্টি করে। তারা উপলব্ধি করে যে, এদেশে ব্রিটিশদের জীবন মোটেই আর নিরাপদ নয়। এই বিপ্লবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গীতিকার মোহিনী চৌধুরীর ভাষায় বলা যায়, “মুক্তির মন্দির সোপানতলে, কত প্রাণ হল বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে। “ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারের নাম রাখা হয়েছে ‘বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ’ বা সংক্ষেপে
বি-বা-ন্দী বাগ।

(4). পাঞ্জাবে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের বিবরণ দাও।

পাঞ্জাবে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন:-

ভূমিকা:- বিংশ শতকে পাঞ্জাবে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ব্যাপক প্রসার ঘটে যা ব্রিটিশ সরকারের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। লালা হরদয়াল, অজিত সিং, সুফি অম্বাপ্রসাদ, রাসবিহারী বসু প্রমুখ বিপ্লবীর উদ্যোগে পাঞ্জাব বিপ্লবের অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়।

[1] সাহারাণপুর গুপ্তসমিতি: প্রবাসী বাঙালি জে এম চট্টোপাধ্যায়

১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে কয়েকজন যুবককে সঙ্গে নিয়ে পাঞ্জাবের সাহারানপুরে একটি গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি গড়ে তোলেন। এই সমিতিতে পরবর্তীকালে লালা হরদয়াল, সর্দার অজিত সিং, সুফি অম্বাপ্রসাদ প্রমুখ বিপ্লবী যোগ দেন। লালা লাজপৎ রায় এই সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। অজিত সিং ও অম্বাপ্রসাদ কয়েকটি বিপ্লবী পত্রিকা প্রকাশ করেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘স্বরাজ’, ‘ঝিঙ্গের-শিয়াল’ প্রভৃতি।

[2] আর্য সমাজের ভূমিকা: আর্য সমাজের সক্রিয় সহযোগিতায় পাঞ্জাবে বেশ কয়েকটি গুপ্তসমিতি গড়ে ওঠে। এসব সমিতির সদস্যরা বোমা তৈরি, অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ প্রভৃতি কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। পাঞ্জাবের গভর্নর মাইকেল ও’ডায়ার জানান যে, ১৯০৭থেকে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পাঞ্জাবের সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মের জন্য যে অসংখ্য হিন্দু অভিযুক্ত হয়েছিল তারা সকলেই আর্য সমাজের লোক ছিল।

[3] হরদয়ালের ভূমিকা: লালা হরদয়াল ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন

থেকে ফিরে এসে পাঞ্জাবে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের সহায়তায় ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো শহরে ‘গদর পার্টি’ প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতেও এর শাখা গড়ে ওঠে। পাঞ্জাব থেকে এই পার্টির সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘গদর’ প্রকাশিত হতে থাকে।

[4] রাসবিহারী বসুর ভূমিকা: প্রবাসী বাঙালি বিপ্লবী রাসবিহারী

বসু পাঞ্জাবের বিভিন্ন বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বৈপ্লবিক আদর্শের প্রচার শুরু করেন। তাঁর পরামর্শে তাঁর অনুগামী বসন্ত বিশ্বাস দিল্লিতে বড়োলাট লর্ড হার্ডিঞ্চের শোভাযাত্রায় বোমা নিক্ষেপ করে। রাসবিহারীর পরিকল্পনা অনুযায়ী পাঞ্জাবের সহকারী পুলিশ কমিশনার গর্ডনকে হত্যার উদ্দেশ্যে লাহোরের লরেন্স গার্ডেনে বিপ্লবীরা বোমা রাখেন। তিনি ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের গোপন পরিকল্পনা করেন। অবশ্য বাস্তবায়নের আগেই এই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়।

[5] ভগৎ সিং-এর ভূমিকা: সাইমন কমিশন-বিরোধী আন্দোলনের

সময় পুলিশের লাঠির আঘাতে পাঞ্জাবের বিপ্লবী নেতা লালা লাজপৎ রায়ের মৃত্যু হয়। এর প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে বিপ্লবী ভগৎ সিং, রাজগুরু ও আজাদ পুলিশ অফিসার সন্ডার্সকে হত্যা (১৯২৮ খ্রি.) করেন। পরের বছর ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লি আইনসভায় বোমা নিক্ষেপ করেন। পরে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হয়ে ভগৎ সিং, রাজগুরু ও শুকদেবের ফাঁসি (১৯৩১ খ্রি.) হয়।

উপসংহার:- পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। ফলে সরকার বিপ্লবীদের ওপর তীব্র দমনপীড়ন শুরু করে। ধীরে ধীরে পাঞ্জাবের বিপ্লবী আন্দোলনের গতি হ্রাস পায়।

প্রশ্ন মান – ৪

(1). ‘অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি সম্পর্কে টীকা লেখো। অথবা, শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু স্মরণীয় কেন?

উত্তর:-

অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি:-

ভূমিকা: ছাত্রদের ব্যাপক অংশগ্রহণের ফলে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে ছাত্র আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে বাংলার সরকারের মুখ্য সচিব আর ডব্লিউ কার্লাইল তীব্র দমনমূলক এক সার্কুলার জারি করেন যা কার্লাইল সার্কুলার নামে পরিচিত।

[1] প্রেক্ষাপট: ছাত্র আন্দোলন ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে কার্লাইল সার্কুলার-এর দ্বারা সরকার ছাত্রদের মিটিং-মিছিল ও সভাসমিতি নিষিদ্ধ করে। পাশাপাশি ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি উচ্চারণেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এই দমনমূলক ঘোষণার বিরুদ্ধে ছাত্রদের উদ্যোগে অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি (নভেম্বর, ১৯০৫ খ্রি.) গড়ে ওঠে।

[2] প্রতিষ্ঠা: কলকাতার রিপন কলেজের (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) ছাত্রনেতা এবং সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগামী শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু কার্লাইল সার্কুলার-এর বিরুদ্ধে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর সভাপতি ছিলেন কৃয়কুমার মিত্র এবং সম্পাদক ছিলেন শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু।

[3] কার্যাবলি: এই সোসাইটির প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ছিল-[I] ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ করে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত রাখা, [11] ছাত্রদের উৎসাহিত করা, [iii] সরকারি স্কুলকলেজ থেকে বিতাড়িত বা শাস্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের বিকল্প শিক্ষালাভের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি।

[4] সক্রিয়তা: অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটির উদ্যোগে ব্রিটিশবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নতুন গতি আসে। শচীন্দ্রপ্রসাদ ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে একটি পতাকারও নকশা করেন। তিনি নিয়মিত ছাত্রদের সংঘবদ্ধ করার কাজ চালিয়ে যান। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে সরকার তাঁকে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে গ্রেফতার করে রাওয়ালপিন্ডি জেলে বন্দি করে।

উপসংহার: কার্লাইল সার্কুলার ছিল বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দমনের উদ্দেশ্যে প্রণীত এক কালাকানুন। এর মোকাবিলা করে অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটিই ছাত্রদের প্রকৃত বন্ধু হয়ে ওঠে। শচীন্দ্রপ্রসাদ বসুর উদ্যোগে গঠিত অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি বিতাড়িত ছাত্রদের বিকল্প পথের সন্ধান দিতে সক্ষম হয়।

(2). *অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে (১৯২০-২২ খ্রি.) ভারতের ছাত্র আন্দোলনের পরিচয় দাও।

উত্তর:-

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ভারতের ছাত্র’ আন্দোলন

ভূমিকা:- বিভিন্ন কারণে জাতীয় কংগ্রেস মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

[1] শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জন: আন্দোলনে যোগ দিয়ে ছাত্ররা সরকারি স্কুলকলেজ ত্যাগ করে। এই সময় মাধ্যমিক স্তরে ১২ লক্ষ ৮১ হাজার ৮১০ জন এবং কলেজ স্তরে ৫২ হাজার ৪৮২ জন ছাত্র সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে বেরিয়ে আসে বলে একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়।

[2] স্বদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন: আন্দোলনের সময় কংগ্রেসের উদ্যোগে বেশ কিছু স্বদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, গুজরাট বিদ্যাপীঠ, বারাণসী বিদ্যাপীঠ, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া প্রভৃতি।

[3] বয়কট আন্দোলন: ছাত্ররা বিদেশি পণ্যের দোকানের সামনে পিকেটিং চালায়, বিলিতি পণ্যে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং বিদেশি পণ্য বর্জনের প্রচার চালিয়ে বয়কট আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলে। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, বোম্বাই-সহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ছাত্রদের বয়কট আন্দোলন খুবই জোরদার হয়ে ওঠে।

[4] আন্দোলনের প্রসার: ছাত্রদের বয়কট আন্দোলন বাংলায় খুবই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসের মধ্যে কলকাতার বেশিরভাগ কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। কলকাতার বাইরেও ছাত্র আন্দোলন ব্যাপক আকার নেয়।

উপসংহার:- অসহযোগ আন্দোলনের সময় ছাত্র আন্দোলন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠলেও উত্তরপ্রদেশের চৌরিচৌরা গ্রামে উত্তেজিত জনতা থানার ২২ জন পুলিশকে পুড়িয়ে মারলে (১৯২২ খ্রি.) গান্ধিজি আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। ফলে ছাত্র আন্দোলনও ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং একমসয় আন্দোলন থেমে যায়।

(3).’আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে (১৯৩০-৩৪ খ্রি.) ভারতের উত্তর ছাত্র আন্দোলনের বিবরণ দাও।

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ভারতের ছাত্র আন্দোলন:-

ভূমিকা:- মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ভারতের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করেন। এই আন্দোলনে ভারতের ছাত্রসমাজ আন্তরিকভাবে যুক্ত হয়ে আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলে।

[1] বয়কট আন্দোলন: আইন অমান্য আন্দোলনে শামিল হয়ে বিভিন্ন প্রদেশের ছাত্ররা তীব্র বয়কট আন্দোলন শুরু করে। তাদের উদ্যোগে বিলিতি পণ্য বর্জন, বিদেশি পণ্যের দোকানের সামনে পিকেটিং, বিদেশি পণ্যে অগ্নি-সংযোগ প্রভৃতি চলতে থাকে। গান্ধিজির নির্দেশের অপেক্ষা না করে বহু ছাত্র সরকারি স্কুলকলেজ ছেড়ে বেরিয়ে আসে।

[2] সক্রিয়তা: ছাত্ররা বিভিন্ন স্থানে ধর্মঘট শুরু করে। তারা জাতীয় পতাকার রং নিজেদের পোশাকে ব্যবহার করে পুলিশের সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে। এই সময় বোম্বাই, গুজরাট, পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম প্রভৃতি প্রদেশে সক্রিয় ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়।

[3] আন্দোলনের প্রসার: গুজরাটের আমেদাবাদ, সুরাট ও খেদা জেলায় স্কুলকলেজের প্রচুর ছাত্র এই আন্দোলনে যোগ দেয়। আসামে শিক্ষা অধিকর্তা কানিংহামের স্বৈরাচারী নীতির বিরুদ্ধে সেখানকার ছাত্ররা প্রবল আন্দোলন শুরু করে। বাংলার শ্রীহট্ট জেলায় ব্যাপক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পরীক্ষা এর ফলে বাতিল হয়ে যায়।

[4] আন্দোলনের অবসান: সরকারি বিভেদনীতি, উচ্চ ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে বিভেদ প্রভৃতির ফলে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আইন অমান্য আন্দোলন তার গতি হারাতে থাকে। গান্ধিজি ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে আন্দোলন প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করলে ছাত্র আন্দোলনও সাময়িকভাবে থেমে যায়।

উপসংহার: ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আইন অমান্য আন্দোলনে ভাটা পড়লেও ছাত্র আন্দোলনের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকে। পরে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে তা আবার অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে ।

(4). “ভারত ছাড়ো আন্দোলন বা আগস্ট আন্দোলন পর্বে
(১৯৪২ খ্রি.) ভারতের ছাত্র আন্দোলনের বিবরণ দাও।

ভারত ছাড়ো বা আগস্ট আন্দোলন পর্বে ভারতের ছাত্র আন্দোলন

ভূমিকা:- নানা পরিস্থিতিতে গান্ধিজির নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু করার কথা ঘোষণা করেন। এর সঙ্গে সঙ্গে ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে যোগ দেয়।

[1] নেতৃত্বহীনতা: ভারত ছাড়ো আন্দোলন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেছাত্রসমাজ নিজেদের মতো করে আন্দোলন শুরু করে। বাংলা, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, উড়িষ্যা প্রভৃতি প্রদেশে ছাত্ররা বিপুল

সংখ্যায় আন্দোলনে শামিল হয়।

১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় ব্রিটিশবিরোধী বিক্ষোভ প্রদর্শনে ছাত্রীরা

[2] উত্তরপ্রদেশে আন্দোলন: উত্তরপ্রদেশে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় ও বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আন্দোলনের সপক্ষে প্রচার চালিয়ে সাধারণ মানুষকে আন্দোলনমুখী করে তোলে। ছাত্ররা বিভিন্ন নাশকতামূলক কাজে যুক্ত হয়ে পড়ে। বারাণসীর ছাত্রদের সক্রিয়তায় পাঁচ দিন ধরে সরকারি প্রশাসন স্তন্ধ হয়ে যায়।

[3] দক্ষিণ ভারতে আন্দোলন: দক্ষিণ ভারতে আন্দোলনরত ছাত্ররা ধর্মঘট চালাতে থাকে। গোদাবরীর তীরে ব্রিটিশ পুলিশ আন্দোলনরত পাঁচ জন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করে।

[4] অন্যান্য রাজ্যে আন্দোলন: বিহারে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষে ৭ জন ছাত্র মারা যায়। বাংলায় ছাত্র আন্দোলন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কলকাতা ও মেদিনীপুরের ছাত্ররাও অতি সক্রিয় হয়ে ওঠে। গুজরাটে স্কুলপড়ুয়া বালক-বালিকাদের নিয়ে গড়ে ওঠে বানর সেনা নামে সংগঠন।

উপসংহার: ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল এক স্বতঃস্ফূর্ত জনজাগরণ। ছাত্রদের অংশগ্রহণ এই আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সাফল্য ছাত্রদের অংশগ্রহণের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল।

(5)বিংশ শতকে বাংলায় সশস্ত্র বিপ্লবী ছাত্র আন্দোলনের প্রসার সম্পর্কে আলোচনা করো।

উত্তর:-

বাংলায় সশস্ত্র বিপ্লবী ছাত্র আন্দোলনের প্রসার

ভূমিকা: বিংশ শতকে ভারতে অহিংস আন্দোলনের পাশাপাশি সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনেও বাংলার ছাত্রসমাজ যোগ দেয়।

[1] বিপ্লবী সমিতি গঠন: বাংলায় সতীশচন্দ্র বসু, প্রমথনাথ মিত্র, পুলিনবিহারী দাস, বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, হেমচন্দ্র কানুনগো প্রমুখের উদ্যোগে বিভিন্ন বিপ্লবী গুপ্তসমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল-[i] কলকাতার অনুশীলন সমিতি (১৯০৬ খ্রি.), যুগান্তর গোষ্ঠী, [ii] ঢাকার অনুশীলন সমিতি, মুক্তি সংঘ, [iii] ফরিদপুরের ব্রতী সমিতি, [iv] ময়মনসিংহের সাধনা সমিতি ও সুহৃদ সমিতি প্রভৃতি।

[2] কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টা: অত্যাচারী বিচারপতি

কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে গিয়ে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি বোমা ছুঁড়ে ভুল করে মিসেস কেনেডি ও তাঁর কন্যাকে হত্যা করেন। পরে প্রফুল্ল চাকি আত্মহত্যা করলেও ক্ষুদিরাম ধরা পড়ে ফাঁসিতে প্রাণ দেন (১৯০৮ খ্রি.)।

[3] বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে মামলা: বাংলার বহু বিপ্লবীর বিরুদ্ধে আলিপুর বোমা মামলা (১৯০৮ খ্রি.), ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলা (১৯১০ খ্রি.), হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলা (১৯১০ খ্রি.), বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা (১৯১২-১৩ খ্রি.) প্রভৃতি দায়ের করা হয়।

[4] মুখোমুখি যুদ্ধ: বিপ্লবী বাঘাযতীন উড়িষ্যার বালেশ্বরে গিয়ে

জার্মানি থেকে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা চালান। কিন্তু সেখানে বুড়িবালাম নদীর তীরে পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধে (১৯১৫ খ্রি.) তিনি আহত হয়ে পরে মারা যান। এসময় মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের (১৯৩০ খ্রি.) ঘটনা ঘটে। বিপ্লবী বিনয়-বাদল-দীনেশ কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ (১৯৩০ খ্রি.) করেন, যা অলিন্দ যুদ্ধ নামে পরিচিত।

উপসংহার: বিংশ শতকে বাংলায় সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের অগ্রভাগে থেকে বাংলার ছাত্ররা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে অত্যন্ত শক্তিশালী করেছিল। বস্তুত শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন যখন বিশেষ সাফল্য পাচ্ছিল না, তখন ছাত্রদের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনই ব্রিটিশদের আতঙ্কিত করতে সক্ষম হয়েছিল।

(6) আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দি সেনাদের মুক্তির দাবিতে ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।

উত্তর:-

বন্দি আজাদ হিন্দ সেনাদের মুক্তির দাবিতে ছাত্র আন্দোলন

ভূমিকা: স্বাধীনতার জন্য নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারতের ব্রিটিশ শক্তিকে আক্রমণ করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই যুদ্ধে বিপর্যস্ত হয়ে বহু আজাদি সেনা ব্রিটিশদের হাতে বন্দি হয়। তাঁদের মুক্তির দাবিতে ভারতে তীব্র ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়।

[1] বন্দি সেনাদের বিচারের প্রতিক্রিয়া: দিল্লির লালকেল্লায় সামরিক আদালতে বন্দি আজাদি সেনাদের বিচার শুরু হলে (৫ নভেম্বর, ১৯৪৫ খ্রি.)-এর প্রতিবাদে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে।

[2] মিছিল ও অবরোধ: কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ভারতের ছাত্র ফেডারেশন এবং ইসলামিয়া কলেজের (বর্তমান মৌলানা আজাদ কলেজ) প্রচুর ছাত্র ডালহৌসি স্কোয়ারের উদ্দেশ্যে মিছিল করে। কিন্তু পুলিশ মিছিল আটকে দিলে ছাত্ররা ধর্মতলা স্ট্রিট (বর্তমান লেনিন সরণি) অবরোধ করে।

[3] মিছিলে গুলি: ছাত্রদের জমায়েতে পুলিশ গুলি চালালে (২১ নভেম্বর) ক্যালকাটা টেকনিক্যাল স্কুলের রামেশ্বর চট্টোপাধ্যায় নামে এক ছাত্র নিহত হয় এবং বেশকিছু ছাত্র আহত হয়।

[4] ধর্মঘট: পুলিশের গুলিচালনার প্রতিবাদে কলকাতার ছাত্ররা ২২ ও ২৩ নভেম্বর ধর্মঘট পালন করে। বহু গাড়িতে আগুন লাগানো হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে পুলিশ আবার গুলি চালায়।

[5] গভর্নরের রিপোর্ট: বাংলার ছাত্র আন্দোলন এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে তৎকালীন গভর্নর তাঁর রিপোর্টে বড়োলাট ওয়াভেলকে লেখেন যে, “পরিস্থিতি খুবই বিস্ফোরক ও বিপজ্জনক। ছাত্রদের ওপর গুলি চালালেও তারা দাঁড়িয়েই থাকছে বড়োজোর একটু পিছিয়ে গিয়ে আবার আক্রমণ করছে।”

উপসংহার: আজাদ হিন্দ সেনাদের মুক্তির দাবিতে ভারতীয় ছাত্ররা যে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তা ব্রিটিশ শাসকদের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। ইংরেজ পুলিশের বন্দুকের গুলির সামনে দাঁড়িয়ে দুঃসাহসী ছাত্রদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার তৎকালীন গভর্নর ব্যারন ক্যাসি সরকারকে এক রিপোর্টে লেখেন যে, “খুবই বিস্ফোরক ও বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, ছাত্রদের উপর গুলি চালালেও তারা দাঁড়িয়েই থাকছে…।”

You may also like

Madhyamik history

দশম শ্রেণীর ইতিহাসের ধারণা প্রথম অধ্যায় প্রশ্ন উত্তর

১) ভারতের নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার জনক হলেন- (A) রনজিত গুহ (B) অমলেশ ত্রিপাঠী (C) সুমিত সরকার (D) রামচন্দ্র গুহ উঃ