Class 12 Bengali

বিভাব নাটকের বড় প্রশ্ন ও উত্তর

বিভাব নাটকের বড় প্রশ্ন ও উত্তর

১.”সংস্কৃত হিসাবে তিনি ঠিক কী বেঠিক সে বিবেচনা করবেন সংস্কৃত পণ্ডিতেরা, কিন্তু নামের দিক থেকে আমাদের একটা সামান্য আপত্তি আছে।” নাট্যকারের এই মন্তব্যটি বিশ্লেষণ করো।

উত্তর:- কথামুখ:- জনৈক ভদ্রলোক পুরোনো নাট্যশাস্ত্র ঘেঁটে শম্ভু মিত্র রচিত নাটকের নাম দিয়েছিলেন ‘বিভাব’। ‘বিভাব’ শব্দটির অর্থ হল মনের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া নয়টি রসানুভূতির কারণ। লেখকের আপত্তির কারণ: নিজের নাট্যভাবনা ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে এই নামের বিরোধ খুঁজে পেয়েছেন স্বয়ং নাট্যকারই। তাঁর মনে হয়েছে, তাঁদের নাটকের নাম হওয়া উচিত ‘অভাব নাটক’। কারণ প্রবল অভাব থেকেই তাঁদের এই নাটকের জন্ম। আপত্তির কারণ বিশ্লেষণ: সেখানে ভালো মঞ্চ নেই, নেই আলো বা ঝালর ইত্যাদি মঞ্চসজ্জার বিবিধ উপকরণ। থাকার মধ্যে শুধু আছে নাটক করার অদম্য ইচ্ছা। এর ওপর রয়েছে সরকারের চূড়ান্ত অসহযোগিতাও। এত কষ্ট করে সব কিছু জোগাড় করে অভিনয়ের ব্যবস্থা করা হলেও উঠে আসে খাজনার দাবি। পেশাদারি মঞ্চকে এই খাজনা দিতে হয় না, কিন্তু গ্রুপ থিয়েটারকে তা দিতে হয়। সরকারের এই বিমাতৃসুলভ দৃষ্টিভঙ্গিকে তীব্র শ্লেষে বিদ্ধ করে নাট্যকার এরপর নিজের ক্ষোভ উগরে দিয়ে জানান-“… আমরা তো নাটক নিয়ে ব্যবসা করি না, তাই সরকার। আমাদের গলা টিপে খাজনা আদায় করে নেন।” শেষের কথা: এই চূড়ান্ত প্রতিকূলতায় গ্রুপ থিয়েটারের পক্ষে নিজের পায়ে দাঁড়ানো অনেক সময়েই সম্ভব হয়ে ওঠে না। গ্রুপ থিয়েটারের প্রবল অভাব এবং সমস্যার জন্যই নাট্যকার। নাটকটির নামের ক্ষেত্রেও আপত্তি জানিয়েছেন।

২. “ভাই অনেক ভেবেচিন্তে আমরা একটা প্যাঁচ বের করেছি।”-কে, কোন্ প্রসঙ্গে মন্তব্যটি করেছেন তা আলোচনা করো।

উত্তর:- উদ্দিষ্ট ব্যক্তি:- শম্ভু মিত্র তাঁর ‘বিভাব’ নাটকের সূচনায় গ্রুপ থিয়েটারের নাটক অভিনয়ের ক্ষেত্রে নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। প্রসঙ্গ: গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘দূরস্ত অভাব’। তাঁদের অভিনয়ের জন্য ভালো মঞ্চ নেই, নেই মঞ্চসজ্জার উপকরণ বা আলো। শুধু নাটক করার অদম্য ইচ্ছাকে পাথেয় করেই চলে গ্রুপ থিয়েটার। কিন্তু সেখানেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সরকারের বিমাতৃসুলভ আচরণ। পেশাদার থিয়েটারকে ছাড় দিলেও গ্রুপ থিয়েটারের কাছ থেকে সরকার খাজনা আদায় করে। ফলে চূড়ান্ত আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হয় গ্রুপ থিয়েটার। সমস্যামুক্তির পথ: এই সমস্যা থেকে মুক্তির পথও তাই তাঁরা নিজেদের মতো করেই খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। এমন এক অভিনয়ের পরিকল্পনা তাঁরা করেন, যেখানে মঞ্চের কোনো প্রয়োজন হবে না। যে-কোনোরকম একটা প্ল্যাটফর্ম হলেই চলবে। কোনোরকম মঞ্চসজ্জা বা নাট্য-উপকরণ যেমন দরজা-জানলা, টেবিল-বেও, সিনসিনারি ইত্যাদির দরকার পড়বে না। নাটকের প্রাচীন ঐতিহ্য থেকেই এই অভিনয়রীতির সমর্থন পান নাট্যকার শম্ভু মিত্র। শেষের কথা: এভাবেই যাবতীয় প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে গ্রুপ থিয়েটারের এগিয়ে চলার পথ সন্ধান প্রসঙ্গেই তিনি মন্তব্যটি করেছেন।

৩.আমাদের মনে হয় এর নাম হওয়া উচিত ‘অভাব নাটক’।”- অভাবের চিত্র ‘বিভাব’ নাটকে কীভাবে প্রকাশ পেয়েছে লেখো ?

উত্তর:- কথামুখ। শম্ভু মিত্রের ‘বিভাব’ নাটকে আমরা দেখি, জনৈক ভদ্রলোক পুরোনো নাট্যশাস্ত্র ঘেঁটে শম্ভু মিত্র রচিত নাটকের নাম দিয়েছিলেন ‘বিভাব’। ‘বিভাব’ শব্দটির অর্থ হল মনের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া নয়টি রসানুভূতির কারণ। লেখকের উপলব্ধি: নিজের নাট্যভাবনা ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে এই নামের বিরোধ খুঁজে পেয়েছেন স্বয়ং নাট্যকারই। একারণেই তাঁর মনে হয়েছে, তাঁদের নাটকের নাম হওয়া উচিত ‘অভাব নাটক’। প্রবল অভাব থেকেই তাঁদের এই নাটকের জন্ম। উপলব্ধির কারণ:- এই নাটকে ভালো মঞ্চ নেই, নেই আলো বা ঝালর ইত্যাদি মঞ্চসজ্জার বিবিধ উপকরণ। থাকার মধ্যে শুধু আছে নাটক করার অদম্য আকাঙ্ক্ষা। এর ওপর রয়েছে সরকারের চূড়ান্ত অসহযোগিতাও। এত কষ্ট করে সব কিছু জোগাড় করার পর অভিনয়ের ব্যবস্থা করা হলেও উঠে আসে খাজনার দাবি। পেশাদারি মঞ্চকে যে খাজনা দিতে হয় না, গ্রুপ থিয়েটারকে তা দিতে হয়। সরকারের এই বিমাতৃসুলভ দৃষ্টিভঙ্গিকে তীব্র শ্লেষে বিদ্ধ করে নাট্যকার এরপর নিজের ক্ষোভ উগরে দিয়ে জানান-*আমরা তো নাটক নিয়ে ব্যবসা করি না, তাই সরকার আমাদের গলা টিপে খাজনা আদায় করে নেন।” শেষের কথা: এই চূড়ান্ত প্রতিকূলতায় গ্রুপ থিয়েটারের পক্ষে নিজের পায়ে দাঁড়ানো অনেক সময়েই সম্ভব হয়ে ওঠে না। গ্রুপ থিয়েটারের প্রবল অভাবের এই চিত্রই ‘বিভাব’ নাটকে প্রকাশ পেয়েছে।

৪.তবে হ্যাঁ, মানতে পারে, যদি সাহেবে মানে। যেমন রবি- ঠাকুরকে মেনেছিল।”-মন্তব্যটির তাৎপর্য আলোচনা করো ?

উত্তর:- তাৎপর্য বিশ্লেষণ:- যে অজস্র প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে গ্রুপ থিয়েটারকে নাটকে অভিনয় করতে হয়, সেই প্রতিকূলতার উল্লেখ করেছেন শম্ভু মিত্র তাঁর ‘বিভাব’ নাটকের সূচনায়। সমস্যার বিষয়: এইসব সমস্যার মধ্যে একদিকে যেমন আছে সরকারের বিমাতৃসুলভ আচরণ তেমনই অন্যদিকে রয়েছে মঞ্জু, মঞ্চসজ্জা, আলো ইত্যাদি অভিনয়ের প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাবও। সমস্যামুক্তির উপায়:- এইসব সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য নাট্যকার শম্ভু মিত্র নিজের মতো করে সমাধানের পথ সন্ধান করেছেন। প্রাচীন বাংলা নাটক, উড়ে যাত্রা কিংবা মারাঠি তামাশায় তিনি দেখেছেন যে, শুধু ভঙ্গিকে আশ্রয় করে কল্পনার সাহায্য নিয়ে বিষয়কে দর্শকের সামনে ফুটিয়ে তোলা হয়। এই ধরনের বিভিন্ন নাট্যকৌশল থেকে অভিনয়ের এক নিজস্ব আঙ্গিক আবিষ্কারের চেষ্টা করেন শম্ভু মিত্র। গ্রহণযোগ্যতা:- কিন্তু পরমুহূর্তে শহরের তথাকথিত শিক্ষিত এবং সাহেবি কেতায় অভ্যস্ত ইংরেজি জানা মানুষদের কাছে এই ধরনের অভিনয় গ্রহণযোগ্য হবে কি না সে বিষয়ে নাট্যকারের মধ্যে সংশয়ও দেখা দেয়। তাঁর মনে হয়েছে, যদি ইংরেজরা বা সাদা চামড়ার সাহেবরা এই অভিনয় ধারাকে মেনে নেয়, তাহলেই তা সহজে এ দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। এরূপ হয়েছিল নোবেল পদক পাওয়ার পর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের ক্ষেত্রে। ইতিকথা:- বলা বাহুল্য, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির ঔপনিবেশিক মানসিকতাকেই এখানে নাট্যকার ব্যঙ্গ করেছেন।

৫.”আর একবার এক মারাঠি তামাশায় দেখেছিলাম” কী দেখেছিলেন বর্ণনা করো এবং তার কোনো দূরবর্তী ছায়া কি ‘বিভাব’-এ দেখা যায়? ৩+২

উত্তর:- দৃশ্যমান বিষয়:- ‘বিভাব’ নাটকের প্রস্তাবনায় নাট্যকার শম্ভু মিত্র জানিয়েছেন যে, মারাঠি তামাশায় তিনি দেখেছিলেন মঞ্চের একপাশে দাঁড়িয়ে চাষি তার জমিদারের কাছে কাতর প্রার্থনা করে এবং শেষে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে মন্দিরে যায় ভগবানের কাছে নালিশ জানাতে। এই যাওয়ার অর্থ মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যাওয়া নয়। সে তক্তার উপরে কয়েকবার গোল হয়ে এমনভাবে ঘুরপাক খেল যেন মনে হল গ্রামটা অতিক্রম করে যাচ্ছে। তারপরে অন্যপাশে গিয়ে কাল্পনিক মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে ভগবানকে মনের দুঃখের কথা নিবেদন করতে থাকল। এদিকে জমিদার সেজে যে অভিনেতা এতক্ষণ অভিনয় করছিল সে দর্শকদের সামনেই মুখে দাড়ি-গোঁফ এঁটে পুরোহিত সেজে অন্যদিকে চাষির সামনে গিয়ে ধর্মীয় তর্জন শুরু করে দিল। মাঠ ভরতি দর্শক চোখের সামনে দৃশ্য ও সাজসজ্জার এই রূপান্তর মেনে নিয়েছিল।

‘বিভাব’-এ দৃশ্যমান বিষয়ের প্রভাব:- মারাঠি তামাশার এই ভঙ্গিনির্ভর অভিনয়শৈলী নাট্যকারকে ‘বিভাব’ নাটকের পরিকল্পনায় অনুপ্রাণিত করেছিল। তাই দেখা যায়, ‘বিভাব’ নাটকে মঞ্চসজ্জার কোনো উপকরণ ছাড়াই শুধু ভঙ্গির সাহায্যে বিষয়ের কাল্পনিক উপস্থাপন ঘটেছে। দোতলায় ওঠা কিংবা শেষে নীচে রাস্তায় নেমে যাওয়া থেকে সিগারেট খাওয়া, চেয়ারটেবিল সরানো, ঘরকে রাস্তায় বদলে ফেলা, একেবারে শেষে নানারকম যানবাহনের ছবি ধরে মুখের সাহায্যে সেগুলোর মতো শব্দ করা-এই সামগ্রিক নাট্যভাবনাতেই নাট্যকার দর্শকের কল্পনাশক্তিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এই সাহস তিনি যেমন সঞ্চয় করেছিলেন উড়িষ্যার যাত্রা থেকে সেরকমই মারাঠি তামাশা থেকেও।

৬. “আর একবার এক মারাঠি তামাশায় দেখেছিলাম” বক্তা মারাঠি তামাশায় কী দেখেছিলেন? বক্তা কোন্ প্রসঙ্গে মারাঠি তামাশার কথা বলেছিলেন?৪+১

উত্তর:- মারাঠি তামাশায় দেখা বিষয়:- শম্ভু মিত্রের লেখা ‘বিভাব’ নাটক থেকে সংকলিত এই উদ্ধৃতিটিতে নাট্যকারের দেখা মারাঠি তামাশার প্রসঙ্গ রয়েছে। নাট্যকার শ্রী শম্ভু মিত্র মারাঠি তামাশায় দেখেন যে, মঞ্চের একদিকে দাঁড়িয়ে থেকে চাষি জমিদারের কাছে অনেক অনুরোধ-উপরোধ করে। তার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হলে সে মন্দিরে যায় ভগবানের কাছে অভিযোগ জানাতে। চাষি মন্দিরে গেলেও মঞ্চের বাইরে সে গেল না, মঞ্চের তক্তার ওপর কয়েকবার সে এমনভাবে ঘুরপাক খেল যে, তাকে দেখে মনে হল সে যেন গ্রামটা পেরিয়ে গেল। তারপর একপাশে গিয়ে সে কাল্পনিক মন্দিরকে লক্ষ করে ভগবানের উদ্দেশে তার মনের দুঃখ কথা নিবেদন করতে লাগল। কিছু আগে যে জমিদারের পাঠ করেছিল, সে মঞ্চে দাঁড়িয়েই মুখে দাড়ি-গোঁফ এঁটে পুরোহিত সাজল এবং মন্দিরের সামনে দাঁড়ানো চাষির কাছে এসে ধর্মীয় তর্জনগর্জন করতে লাগল। শ্রী শম্ভু মিত্র মারাঠি তামাশার এই দৃশ্যই দেখেছিলেন এবং তিনি এও লক্ষ করেছিলেন যে, মাঠ-ভরতি দর্শক এই আজব অভিনয় নিঃশব্দে বিনা বাক্যে দেখে চলেছে।

প্রসঙ্গ:- নাট্যকার শম্ভু মিত্র গ্রুপ থিয়েটারের নানাবিধ অসুবিধার কথা বলতে গিয়ে বলেন যে, মঞ্চ বা মঞ্চসজ্জার উপকরণসমূহ না থাকা সত্ত্বেও নাটক মঞ্চস্থ করা যায়। এই সিদ্ধান্তটা কীভাবে তার মাথায় এল, তার কারণ হিসেবেই নাট্যকার মারাঠি তামাশার প্রসঙ্গ এনেছেন।

৭.”এমনি সময় হঠাৎই এক সাহেবের লেখা পড়লাম।”-‘এমনি সময়’ বলতে কোন্ পরিস্থিতির কথা বলা হয়েছে। সাহেবের নাম কী? তিনি কী লিখেছিলেন? ২+১+২

উত্তর:- শম্ভু মিত্র তাঁর নাট্যদলে অভিনয় করতে গিয়ে নানারকম বাধার মুখোমুখি হচ্ছিলেন। আর্থিক সীমাবদ্ধতায় তাদের ভালো মঞ্চ, দৃশ্যসজ্জার উপকরণ সংগ্রহ ইত্যাদি কিছুই সম্ভব হচ্ছিল না, অন্যদিকে সরকারের তরফ থেকে ছিল খাজনা আদায়ের জবরদস্তি। এই অবস্থায় এক বিকল্প নাট্য প্রযোজনার পথ খুঁজছিলেন নাট্যকার, যেখানে মঞ্জু, দৃশ্যসজ্জা বা সরকারের অনুমোদন ইত্যাদি কোনো কিছুরই প্রয়োজন হবে না। উড়িয়া যাত্রাপালা কিংবা মারাঠা তামাশা থেকে তিনি ভঙ্গিসর্বস্ব এক অভিনয়রীতি খুঁজে পান, যেখানে মঞ্চলজ্জার কোনো প্রয়োজনই নেই। কিন্তু নাট্যকার দ্বিধায় থাকেন যে, শহরের শিক্ষিত ইংরেজি জানা বাঙালি এই রীতি গ্রহণ করবে কি না। এই দোলাচলতার সময়কেই ‘এমনি সময়’ বলে বুঝিয়েছেন নাট্যকার শম্ভু মিত্র।
নাটকে উল্লিখিত সাহেব হলেন রাশিয়ার বিখ্যাত চিত্র পরিচালক আইজেনস্টাইন।

মস্কোতে অনুষ্ঠিত ভঙ্গিসর্বস্ব জাপানের কাবুকি থিয়েটারের অভিনয় দেখে আইজেনস্টাইন উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। সেখানে এক ‘নাইট’ ক্ষুদ্ধ হয়ে দুর্গ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন এবং কতদূরে চলে এলেন তা বোঝাতে তিনি স্টেজের পিছন দিক থেকে গম্ভীরভাবে এগোতে থাকেন আর শিফটাররা তাঁর ঠিক পিছনে মস্ত দুর্গদ্বার ধরে দাঁড়ায়। নাইট এগোনোর সঙ্গেই এই দরজার মাপ ক্রমশ ছোটো হতে থাকে এবং একই সাথে নাইটের আরও দূরে চলে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রচিত হয়ে যায়। কোনো মৃত্যুদৃশ্য রচনাতেও এই ভঙ্গিকে অবলম্বন করে তাকে আর্টিস্টিক করে তোলা হয়।

৮. “এই পড়ে বুকে ভরসা এল-কারণ সাহেবে একে সার্টিফিকেট দিয়েছে।”-কী পড়ে এবং কেন বক্তার ভরসা এসেছিল? ৪+১

উত্তর:- পড়ার বিষয়:- আলোচ্য মন্তব্যে খ্যাতনামা বুশদেশীয় চিত্রপরিচালক আইজেনস্টাইনের নাটকের রীতি সম্পর্কিত একটি লেখা পড়ার কথা বলা হয়েছে। প্রাচীন নাটকের ধারা: শম্ভু মিত্র তাঁর ‘বিভাব’ নাটকের সূচনায় প্রাচীন বাংলা নাটক, উড়ে যাত্রা, মারাঠি তামাশা ইত্যাদি থেকে ভঙ্গিনির্ভর অভিনয় এবং দর্শকের কল্পনার উপর নির্ভরশীল নিজস্ব ধরন আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁর মনে এই সংশয়ও ছিল যে, শহরের ইংরেজি শিক্ষিত ও সাহেবি কেতায় অভ্যস্ত মানুষদের এই অভিনয়রীতি আদৌ ভালো লাগবে কি না। আইজেনস্টাইন প্রদত্ত বর্ণনা: এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ান চিত্রপরিচালক আইজেনস্টাইনের লেখায় উৎসাহিত হন তিনি। মস্কোতে অনুষ্ঠিত ভঙ্গিসর্বস্ব জাপানের কাবুকি থিয়েটারের অভিনয় দেখে আইজেনস্টাইন উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। সেখানে এক ‘নাইট’ ক্ষুদ্ধ হয়ে দুর্গ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন এবং কতদূর চলে এলেন তা বোঝাতে তিনি স্টেজের পিছন দিক থেকে গম্ভীরভাবে এগোতে থাকেন আর শিফটাররা তাঁর ঠিক পিছনে মস্ত দুর্গদ্বার ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। নাইট এগোনোর সঙ্গেই এই দরজার মাপ ক্রমশ ছোটো হতে থাকে আর একই সাথে নাইটের দূরে চলে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিত রচিত হয়ে যায়। এই ভঙ্গিকে অবলম্বন করে কোনো মৃত্যুদৃশ্য রচনাকেও আর্টিস্টিক করে তোলা হয়।

বন্ধার ভরসার কারণ: এই লেখা শম্ভু মিত্রকে ভরসা দেয়, কারণ সাহেবরা এই ভঙ্গিনির্ভর নাট্যরীতিকে সমর্থন করায় ঔপনিবেশিকতায় বিশ্বাসী শহুরে দর্শকরাও এই রীতিকে মেনে নেবেন বলে তিনি মনে করেন।

৯.তাদের অভিনয় দেখে আইজেনস্টাইন সাহেব অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত হয়ে অনেক কথা লিখেছেন।”-আইজেনস্টাইন সাহেব কে? তিনি কাদের অভিনয় দেখে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন? সেই অভিনয় দেখে তিনি কী লিখেছিলেন? ১+১+৩

উত্তর:- আইজেনস্টাইন সাহেবের পরিচয়:- নাট্যকার শম্ভু মিত্রের ‘বিভাব’ নাটক থেকে গৃহীত উদ্ধৃতিটিতে উল্লিখিত আইজেনস্টাইন সাহেবহলেন প্রখ্যাত এক রাশিয়ান চিত্রপরিচালক।
উদ্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গ:- তিনি জাপানের নৃত্যনির্ভর, ঐতিহ্যশালী কাবুকি থিয়েটারের অভিনেতাদের অভিনয় দেখে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। অভিনয় দেখে আইজেনস্টাইনের লেখা:- আইজেনস্টাইন লেখেন যে, কাবুকি থিয়েটারে দেহ এবং মুখভঙ্গি বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, মঞ্চে এক ‘নাইট’ ক্ষুদ্ধ হয়ে দুর্গ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন এবং কতদূর চলে এলেন তা বোঝাতে তিনি স্টেজের পিছন দিক থেকে গম্ভীরভাবে এগোতে থাকেন। শিফটাররা তাঁর ঠিক পিছনে মস্ত দুর্গদ্বার ধরে দাঁড়ায়। তলোয়ার-যুদ্ধের দৃশ্যে দেখা যায়, দুই যোদ্ধা খাপ থেকে কাল্পনিক তলোয়ার বের করলেন এবং কাল্পনিক যুদ্ধ করতে লাগলেন। একজন অন্যজনের কাল্পনিক খোঁচা খেয়ে লুটিয়ে পড়লেন। মরার আগে একবার তাঁর হাতটা নড়ে উঠল, তারপর একটা পা তিরতির করে কাঁপল, চোখটা দুবার ঘুরল, মাথাটা দুবার নড়ল। শেষে তাঁর জিভ বেরিয়ে গেল। তারপর স্টেজে তাঁর সদ্যবিধবা স্ত্রী ঢুকে যখন প্রবল কান্নাকাটি শুরু করল, তখন সেই মৃত লোকটা উঠে আস্তে করে চলে। গেল। কারণ, তখন দর্শকদের কাছে মহিলার শোকপ্রকাশটাই কাঙ্ক্ষিত দৃশ্য, তার মৃত স্বামীর উপস্থিতি নয়। কাবুকি থিয়েটারের এইসব প্রাসঙ্গিক দৃশ্যগুলির বর্ণনাই দিয়েছিলেন আইজেনস্টাইন।

১০.পৃথিবীতে সবচেয়ে পপুলার জিনিস হচ্ছে প্রেম।” -এই মন্তব্যের প্রসঙ্গ উল্লেখ করো। নাট্যবিষয়ে এই মন্তব্যটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে আলোচনা করো।

উত্তর:- মন্তব্যের প্রসঙ্গ:- শম্ভু মিত্রের ‘বিভাব’ নাটকে দেখা যায়, নাট্যদলের সম্পাদকের নির্দেশে, হাসির নাটক তৈরির উদ্দেশ্যে হাসির রসদ খুঁজতে শম্ভু মিত্র ‘বহুরূপী’ নাট্যগোষ্ঠীর অপর অভিনেতা অমর গাঙ্গুলির বাড়িতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে হাস্যরস সৃষ্টিতে তাঁর প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তখন কীভাবে সার্থকরূপে হাসি সৃষ্টি করা যায়, তা উল্লেখ করতে গিয়ে নাট্যগোষ্ঠীতে ‘বৌদি’ বলে পরিচিত তৃপ্তি মিত্র মন্তব্যটি করেন।

মন্তব্যের তাৎপর্য:- অমর পাঙ্গুলির বক্তব্য অনুযায়ী, যে নাটকে কোনো গল্প নেই, ‘হিউম্যান ইন্টারেস্ট’ বা ‘পপুলার অ্যাপিল’ নেই, তা থেকে যথার্থ হাস্যরস তৈরি হতে পারে না। তাই শম্ভু মিত্রের কল্পিত বসার ভঙ্গি অমর গাঙ্গুলি ও তৃপ্তি মিত্রের কাছে হাসির উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হয় না। এরপরই বউদি তৃপ্তি মিত্র প্রেমকে পৃথিবীর সব থেকে পপুলার জিনিস বলে চিহ্নিত করেন। এর সূত্র ধরে শম্ভু মিত্রকে নায়ক এবং তৃপ্তি মিত্রকে নায়িকা করে মূলত তৃপ্তি মিত্রের নির্দেশনায় একটি প্রেমের দৃশ্যে অভিনয়ের অনুশীলন হয়। কিন্তু মূল উদ্দেশ্য অর্থাৎ হাসি সৃষ্টির প্রচেষ্টা সেখানেও ব্যর্থ হয়। ফলে নতুন প্রেমের দৃশ্য তৈরির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। অর্থাৎ, আপাতভাবে নাটকে ‘প্রেম’ শব্দটিকে রঙ্গতামাশার বিষয় করে তার অবমূল্যায়ন ঘটানোর মধ্য দিয়ে এক সামাজিক প্রবণতাকেই যেন তুলে ধরা হয়, আর তার ভূমিকায় থেকে যায় তৃপ্তি মিত্রের মন্তব্যটি ।

১১….আমাদের একটা লভ সিন করা উচিত।” বক্তার এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে নাটকে যে দৃশ্যটি তৈরি হয়েছে তা নিজের ভাষায় বর্ণনা করো।

উত্তর কথামুখ:- ‘বিভাব’ নাটকে দেখা যায়, শম্ভু মিত্র তাঁর নাট্যদলের সম্পাদকের ইচ্ছা অনুসারে হাসির নাটকের রসদ খুঁজতে সহ-অভিনেতা অমর গাঙ্গুলির বাড়িতে আসেন। সেখানে উপস্থিত তৃপ্তি মিত্র সাধারণ মানুষের গ্রহণযোগ্যতার কথা ভেবে তাঁদের একটি প্রেমের দৃশ্য তৈরি করা উচিত বলে মন্তব্য করেন। ‘লন্ড সিন’-এর পরিকল্পনা: প্রথমেই ঘরের কাল্পনিক চেয়ার- টেবিলগুলো সরিয়ে দৃশ্যের উপযুক্ত পটভূমি তৈরি করা হয়। তারপর শম্ভু মিত্রকে নায়ক, আর বউদি তৃপ্তি মিত্রকে নায়িকার ভূমিকায় নির্বাচন করা হয়। অমর গাঙ্গুলি এতে খানিকটা অপ্রস্তুত হলেও পরে বিষয়টি মেনে নেন। তৃপ্তি মিত্রের নির্দেশনায় মঞ্চটিকেই রাস্তা ভেবে নিয়ে সেখানে কলেজ থেকে আসা নায়িকার সঙ্গে নায়কের ধাক্কাধাক্কির দৃশ্যের পরিকল্পনা করা হয়। ‘লভ সিন’ম এর উপস্থাপনা: ধাক্কা লাগার পরে এক পা পিছিয়ে গিয়ে “কেয়া আপ দেখতে নেহি…”-বলে নায়িকা তৃপ্তি মিত্র শম্ভু মিত্রের গালে একটা চড় কষিয়ে দেন। শম্ভু মিত্র ও অমর গাঙ্গুলি এই আকস্মিক চড়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। শম্ভু মিত্র একে ‘জখমি লভ সিন’ বলে চিহ্নিত করেন। নেপথ্য থেকে হারমোনিয়াম সহযোগে একটি মেয়ের কণ্ঠে কিছুটা ন্যাকামির ভঙ্গিতে ‘মালতী লতা দোলে রবীন্দ্রসংগীতটি শোনা যায়। ইতিকথা: কিন্তু শেষপর্যন্ত শম্ভু মিত্র ও অমর গাঙ্গুলি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোন যে, তাঁদের মূল উদ্দেশ্য অর্থাৎ হাসি সৃষ্টি সম্ভব হচ্ছে না। এভাবেই এই দৃশ্য পরিকল্পনার সমাপ্তি ঘটে।

১২.””আরে সব সময়ে কি aesthetic দিক দেখলেই চলে? Box office বলেও তো একটা কথা আছে?'”-‘বিভাব’ নাটকটি অবলম্বনে বক্তার এই মন্তব্যের তাৎপর্য আলোচনা করো।
অথবা, নান্দনিকতার সঙ্গে জনপ্রিয়তার বিপরীতধর্মিতা ‘বিভাব’ নাটকে কীভাবে প্রকাশ পেয়েছে আলোচনা করো।

উত্তর:- মন্তব্যের তাৎপর্য:- অভিনেতা এবং নাট্যকার শম্ভু মিত্রের ‘বিভাব’ নাটকে নেপথ্যের হারমোনিয়ামবাদক এই মন্তব্যটি করেছেন। ‘বৌদির’ প্রস্তাব: বক্স অফিস মাতাতে বউদি অর্থাৎ তৃপ্তি মিত্রের প্রস্তাবে এবং তাঁরই নির্দেশনায় একটি প্রেমের দৃশ্যের অভিনয় হচ্ছিল। সেখানে নায়ক শম্ভু মিত্রের সঙ্গে কলেজছাত্রী নায়িকা তৃপ্তি মিত্রের কল্পিত রাস্তায় ধাক্কার একটি দৃশ্যে নেপথ্যে হারমোনিয়াম বেজে ওঠে এবং একটি মেয়ের কণ্ঠে শোনা যায় ‘মালতী লতা দোলে’ গানটি। তৃপ্তি মিত্র ফিল্মি কায়দায় গাওয়া সেই রবীন্দ্রসংগীতে ঠোঁট মেলান। বিরক্তি প্রকাশ: ‘কিঞ্চিৎ ন্যাকামির ভঙ্গিতে গাওয়া’ সেই গানটি শুনে শম্ভু মিত্র বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন-“…এই কি রবীন্দ্রনাথের গান হচ্ছে নাকি?” গ্রহণযোগ্যতা: তখনই নেপথ্য থেকে উদ্ধৃত মন্তব্যটি ভেসে আসে। হারমোনিয়ামবাদক বলেন, সবসময় নান্দনিকতা অর্থাৎ শিল্পসৌন্দর্যের দিক নিয়ে। ভাবলে চলে না। অর্থাৎ, দর্শকের চাহিদার কথা মাথায় রেখে শিল্পে এ ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি বা স্খলন হলেও কোনো অসুবিধা নেই। ইতিকথা:- বস্তুতপক্ষে সৃজনশীলতার সঙ্গে জনপ্রিয়তার একটা চিরকালীন দ্বন্দ্ব শিল্পকলায় থেকেই গেছে। শিল্পগতভাবে যা সার্থক তা জনপ্রিয় নাও হতে পারে, আবার জনপ্রিয়তার লক্ষ্যে অনেকসময় শিল্পের বিকার ঘটে থাকে।

১৩.”এই চার দেওয়ালের মধ্যে, এই ঘরের মধ্যে জীবনকে উপলব্ধি করা যাবে না-হাসিও পাবে না…।” বক্তার এই মন্তব্যের তাৎপর্য আলোচনা করো।

উত্তর:- শুরুর কথা:- অভিনেতা ও নাট্যকার শম্ভু মিত্রের ‘বিভাব’ নাটকে নাট্যদলের সম্পাদকের নির্দেশ ছিল বক্স অফিসের চাহিদা অনুযায়ী হাসির নাটক মঞ্চস্থ করার। সেই হাসির নাটকের উপকরণ খুঁজতে শম্ভু মিত্র এসে পৌঁছোন সহ-অভিনেতা অমর গাঙ্গুলির বাড়িতে। হাস্যরস সৃষ্টির প্রয়াস: প্রথমে শম্ভু মিত্র বসার ভঙ্গির মাধ্যমে হাস্যরস সৃষ্টির চেষ্টা করেন, কিন্তু অমর গাঙ্গুলি বউদি তৃপ্তি মিত্র জানিয়ে দেন, “এতে হবে না”, কারণ এর কেমানো অলিয়ান ইন্টারেস্ট’ বা ‘পপুলার অ্যাপিল’ নেই। এরপর তৃপ্তি মিত্রের উদ্যোগে দর্শকদের চাহিদার কথা ভেবে ‘লাভ সিন’ এবং তারপর ‘প্রগ্রেসিভ লভ সার্থক হাসি তৈরি করতে পারে না। সিন’-এর দৃশ্য অভিনীত হয়। কিন্তু বার মিত্র নাটককে চার দেয়ালের গন্ডি থেকে বের করে বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিয়ে যেতে বলেন। তাঁর মতে সেখানেই ‘হাসির খোরাক’, পপুলার জিনিসের খোরাক পাওয়া যাবে। এখানে মূলত জীবনের গভীরতাকে খোঁজার বদলে তার লঘু ব্যঞ্জনা বা ‘খোরাক’-কে খোঁজার দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। একইসঙ্গে বাংলা নাটকের সম্ভা জনপ্রিয়তা খোঁজার যে চেষ্টা, সেদিকেও নাট্যকারের শ্লেষ রয়েছে। শম্ভু মিত্র লিখেছেন-“কিছু গভীর কথা যদি গভীরভাবে বলবার থাকে তার, তবেই সে শিল্পী,… কেবল যদি মনোহরণ করাটাই উদ্দেশ্য হয় তার, তাহলে সে ভাঁড় মাত্র।” এই সস্তা জনপ্রিয়তা খোঁজার প্রবণতাকেই ‘বিভাব’ নাটকে পরোক্ষ শ্লেষের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।

১৪.”এই ঘরের মধ্যে জীবনকে উপলব্দি করা যাবে না”- জীবনকে উপলব্ধি করার জন্য বস্তুা কী করেছিলেন? শেষে তাঁর কীরূপ অভিজ্ঞতা হয়েছিল?

উত্তর:- জীবনকে উপলব্ধির প্রয়াস। ‘বিভাব’ নাটকে নাট্যদলের সম্পাদকের নির্দেশে হাসির নাটকের উপকরণ খুঁজতে শম্ভু মিত্র সহ-অভিনেতা অমর গাঙ্গুলির বাড়িতে যান। সেখানে তৃপ্তি মিত্রের নির্দেশনায় ‘লভ সিন’ এবং ‘প্রগ্রেসিভ লভ সিন’-এর দৃশ্যের অবতারণা করেও যখন হাসি পায় না তখন তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন যে, ঘরের মধ্যে জীবনকে উপলখি করা যাবে না। ‘হাসির খোরাক, পপুলার জিনিসের খোরাক’-এর জন্য চার দেয়ালের বহরে বেরোতে হবে। রাস্তায়, মাঠে, ঘাটে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু কাল্পনিকভাবে রাস্তায় গিয়েও সেখানকার মোটরগাড়ি, বাস, হাত-রিকশা কিংবা চলন্ত ট্রামের মধ্যে হাসির উপকরণের খোঁজ মেলে না।
বন্ধার অভিজ্ঞতা:- হাসির উপাদান নিয়ে শম্ভু মিত্র এবং অমর গাঙ্গুলি যখন হতাশ সেই সময়েই রাস্তায় একটা মিছিল থেকে খাদ্য-বস্ত্রের দাবিতে স্লোগান শোনা যায়। মিছিলের সামনে পুলিশ চলে আসে। তারা আন্দোলনকারীদের ফিরে যেতে বললেও তারা ফিরে যায় না। পুলিশের গুলি চলে। একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে চিৎকার করে পড়ে যায়। হাহাকার আর গোঙানির শব্দের মধ্যেই পুলিশ চলে যায়। এতক্ষণ আড়াল থেকে এইসব দৃশ্য দেখার পরে শম্ভু মিত্র এবং অমর গাঙ্গুলি মঞ্চে প্রবেশ করেন। শম্ভু মিত্র তাঁর হাসির নাটকের সন্ধান শেষ করেন এই বলে-“এবার নিশ্চয়ই লোকের খুব হাসি পাবে জীবনের নির্মম অভিজ্ঞতা এবং সস্তা জনপ্রিয়তার খোঁজে নাটকের প্রযোজনাকে এভাবেই তীব্র শ্লেষে বিদ্ধ করেন নাট্যকার।

১৫.কোথাও জীবনের খোরাক, হাসির খোরাক নেই।”- বক্তার এই মন্তব্যটির কারণ আলোচনা করো।

উত্তর:- কথামুখ:- ‘বিভাব’ নাটকে ঘরের মধ্যে প্রেমের দৃশ্য তৈরি করে তাতে হাসির কোনো উপকরণ খুঁজে না পাওয়ায় চার দেয়ালের বাইরে বেরোনোর প্রস্তাব দেন নাট্যকার ও অভিনেতা শম্ভু মিত্র। হাস্যরস সৃষ্টিতে ব্যর্থতা: প্রথমে কাল্পনিক বসার ভঙ্গির মাধ্যমে এবং পরে ‘লভ সিন’ ও ‘প্রগেসিভ লভ সিন’ অভিনয় করেও সার্থক হাসির নাটক সৃষ্টিতে শম্ভু মিত্র, বউদি তৃপ্তি মিত্র ও সহ-অভিনেতা অমর গাঙ্গুলি ব্যর্থ হন। তখনই নাট্যকার উপলব্ধি করেন ঘরের মধ্যে জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে না। জীবনকে গভীরভাবে বোঝার অক্ষমতা: চার দেয়ালের বাইরে জীবনের যে বিরাট তাৎপর্য আছে, প্রতিদিনের বেঁচে থাকার লড়াই এবং শোষণ ও বঞ্চনার যে করুণ কাহিনি আছে, তা বস্তার চেতনায় ধরা পড়ে না। গণ্ডিবদ্ধ জীবনের বাইরে রাস্তায় মোটরগাড়ি, বাস চলে। হাত-রিকশা নিয়ে মুখে আওয়াজ করতে করতে চালক ছুটে যায়। ঘণ্টী বাজিয়ে ছুটে চলে ট্রাম। কিন্তু বাস্তব জগতের এইসব দৃশ্যের মধ্যে কোথাও হাসির আয়োজন বা উপকরণ বস্তা খুঁজে পান না। এই খুঁজে না পাওয়ার অর্থ অবশ্যই জীবনের যথাযথ তাৎপর্য বোঝার ক্ষেত্রে তাঁর অক্ষমতা। বাংলা নাটকে পপুলারিটি অর্জনের জনা জীবনকে গভীরভাবে বোঝার ক্ষেত্রে যে দৈন্য তৈরি হয়েছিল, প্রশ্নোদৃত মন্তব্যে যেন তারই প্রকাশ ঘটেছে।

১৬.এবার নিশ্চয়ই লোকের খুব হাসি পাবে?”-সমগ্র নাট্যকাহিনির নিরিখে মন্তব্যটির তাৎপর্য আলোচনা করো।

উত্তর সূচনা:- অভিনেতা ও নাট্যকার শম্ভু মিত্রের ‘বিভাব’ নাটকের প্রেক্ষাপটে রয়েছে হাসির নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য হাসির উপকরণের সন্ধান। কিন্তু কোনো বিশেষ ভঙ্গি কিংবা ‘লভ সিন’ বা ‘প্রগেসিভ লভ সিন’ তৈরি করে এই হাসি সৃষ্টিতে ব্যর্থ হন নাট্যকার। হাসির উপকরণ: নাট্যকারের প্রস্তাবমতো চার দেয়ালের বাইরে বেরিয়ে, ব্যস্ত গতিশীল জীবনেও তাঁরা হাসির কোনো উপকরণই খুঁজে পান না। এমন সময়ে ‘চাল’, ‘কাপড়’-এর দাবি জানিয়ে একটি মিছিল আসে। উলটো দিক থেকে হাজির হয় পুলিশও। সার্জেন্ট মিছিলকে ফিরে যাবার নির্দেশ দিলেও স্লোগান চলতেই থাকে। নিরস্ত্র জনগণের ওপর গুলি চালায় পুলিশ এবং একটি ছেলে ও একটি মেয়ে পড়ে যায়। হাহাকার আর গোঙানির শব্দে ভরে ওঠে চারপাশ। পুলিশ চলে গেলে অমর গাঙ্গুলি এবং শম্ভু মিত্রের পুনরায় মঞ্চে আগমন ঘটে। নাগরিক সমাজের উদাসীনতার প্রতি শ্লেষ: মঞ্চে এসেই শম্ভু মিত্র দর্শকদের দিকে তাকিয়ে বলেন “এবার নিশ্চয়ই লোকের খুব হাসি পাবে? -এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে কোথাও যেন সাধারণ মানুষ সম্পর্কে উন্নাসিক নাগরিক সমাজের আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতাকে চাবুক মারা হয়। যারা সন্ত্য মনোরঞ্জনকে উপভোগ করতে চায়, জীবনের গভীরতাকে ছুঁতে চায় না- হাসির উপকরণ খুঁজতে থাকা অভিনেতা শম্ভু মিত্রের বিবেক যেন তাদের সেই উদাসীনতাকেই তাচ্ছিল্য করে।

১৭.বিভাব’ নাটকের মূল বক্তব্য সংক্ষেপে আলোচনা করো।

উত্তর:- কথামুখ:- অভিনেতা ও নাট্যকার শম্ভু মিত্রের ‘বিভাব’ নাটকটি তাঁর নাট্যভাবনা এবং জীবনবোধের এক বিশিষ্ট প্রকাশ। প্রযোজনার ক্ষেত্রে আর্থিক সমস্যা: নাটকের শুরুতেই শম্ভু মিত্র গ্রুপ থিয়েটার প্রযোজনার ক্ষেত্রে আর্থিক সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। পেশাদারি থিয়েটারকে বাদ দিয়ে অন্যধারার নাটক থেকে সরকারের কর আদায়ের বিমাতৃসুলভ আচরণের কথাও উঠে এসেছে নাট্যকারের কথায়। অভিনয় কৌশলের পরিবর্তন:- আর এই সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য মঞ্চের উপকরণ বাদ দিয়ে শুধু ভঙ্গিকে নির্ভর করে আর দর্শকদের কল্পনাশক্তিকে গুরুত্ব দিয়ে কীভাবে নাটক অভিনয়ের কৌশল আয়ত্ত করা সম্ভব, সে-কথাও তিনি বলেছেন। নব্য নাট্যরীতির প্রয়োগ:- নাট্যদলের সম্পাদকের ফরমাশ অনুযায়ী হাসির নাটক মঞ্চস্থ করতে এই নাট্যরীতিকে প্রয়োগ করে শম্ভু মিত্র, অমর গাঙ্গুলি এবং তৃপ্তি মিত্র একাধিক নাট্যদৃশ্যের উপস্থাপনা করেন। বাংলা নাটক কীভাবে জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হওয়ার বদলে জনপ্রিয়তা অর্জনে তার লঘু দিককে তুলে ধরে-তা এই দৃশ্যগুলিতে একেবারে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হাসানোর সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হলে শেষে চরিত্ররা ঘর থেকে বাইরে বের হন বাস্তব জীবনে ‘হাসির খোরাক’ সন্ধানের জন্য। প্রকৃত নাট্যভাবনার অভাববোধ। প্রকৃত নাট্যভাবনার অভাবকে যেন এভাবেই এই নাটকে স্পষ্ট করেন নাট্যকার। আর তা তীব্র হয় কাহিনির শেষে, যখন খাদ্যের দাবিতে গুলি খাওয়া মানুষগুলোকে দেখিয়ে শম্ভু মিত্র বলেন- “এবার নিশ্চয়ই লোকের খুব হাসি পাবে।-নাটক এবং দর্শকদের বুচিকে এভাবেই ‘বিভাব’ নাটকে চূড়ান্ত আঘাত করেছেন নাট্যকার ।

১৮.’বিপ্লব’ নাটকে নাট্যরীতির যে নতুনত্ব প্রকাশ পেয়েছে তা আলোচনা করো।

উত্তর প্রাক্কথন:- অভিনেতা-নাট্যকার শম্ভু মিত্র তাঁর ‘বিভাব’ নাটকে প্রথাগত নাট্যরীতি থেকে সরে এসে নিজস্ব নাট্যরীতির অসাধারণ প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। নিজস্ব নাট্যরীতির সন্ধান:- মঞ্চসজ্জা বা অভিনয় উপকরণের স্বল্পতার বাধা কাটিয়ে নাটক অভিনয়ের জন্যই তিনি এই নিজস্ব নাট্যরীতির সন্ধান করেছেন। এক্ষেত্রে প্রাচীন বাংলা নাটক, উড়ে যাত্রা কিংবা মারাঠি তামাশা হয়ে উঠেছে তাঁর প্রেরণা, সাহস জুগিয়েছে বিখ্যাত রাশিয়ান চিত্রপরিচালক আইজেনস্টাইনের লেখা। নাট্যরীতি বৈশিষ্ট্যের অনুসরণ:- মঞ্চসজ্জা এবং উপকরণের যথাযথ ব্যবহার না করে শুধু ভঙ্গির সাহায্যে দর্শকের কল্পনাশক্তির উপর নির্ভর করে নাট্যবিষয়কে ফুটিয়ে তোলাই এই নাট্যরীতির বৈশিষ্ট্য। নাট্যকারের ব্যঙ্গবাণ: নাটকের সূচনায় শম্ভু মিত্র তাঁর দীর্ঘ বক্তব্যে নিজের নাট্যভাবনাকে যেমন তুলে ধরেন, তেমনই বাঙালির ঔপনিবেশিক মানসিকতাকেও ব্যঙ্গ করেন। এ নাটকের সংলাপ সুগঠিত নয়। নাটকটিতে কিছু মানুষের পারস্পরিক কথোপকথনের মধ্য দিয়ে ভাষার অনেকগুলো স্তর ফুটে উঠেছে, মাঝেমধ্যে একটা এলোমোলো ধরনও তৈরি হয়েছে। এর ফলে নাটকের মধ্যে জীবনের উত্তাপ আরও বেশি করে খুঁজে পাওয়া গেছে। কাহিনি বিন্যাসে চমক: হাসির উপকরণ খুঁজতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মৃত মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে যখন বলা হয়-“এবার নিশ্চয়ই লোকের খুব হাসি পাবে?”- তখন স্থূল হাসি খুঁজতে ব্যস্ত সমাজকে চুপ করিয়ে দেয় নাট্যকারের এই তীব্র ব্যঙ্গ। কাহিনি বিন্যাসের এই চমক নাটককে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দেয়।

১৯.একাঙ্ক নাটক হিসেবে ‘বিভাব’ কতখানি সার্থক তা আলোচনা করো।

উত্তর:- ভূমিকা:- ‘বিভাব’ নাটকের সূচনা অংশে নাট্যকার শম্ভু মিত্র নিজেই এটিকে ‘একাঙ্কিকা’ বলে উল্লেখ করেছেন। বহিরাঙ্গিক বিচারে আয়তনের সংক্ষিপ্ততা এবং চরিত্রের স্বল্পতা এই নাটকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শম্ভু মিত্র, অমর গাঙ্গুলি এবং ‘বৌদি’ তৃপ্তি মিত্র-এই তিনটি চরিত্রকে আশ্রয় করে নাটকটি রচিত। শর্তপূরণ: একাঙ্ক নাটকের শর্ত মেনে একটিমাত্র উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নাটকটি রচিত হয়েছে এবং। তা হল নাটকে হাসির কারণ সন্ধান। কিন্তু তার আড়ালে নাট্যকার আসলে স্পষ্ট করতে চেয়েছেন, জীবনের প্রকৃত স্বরূপকে বিসর্জন দিয়ে স্থূল হাসির জন্য দর্শকদের ও তথাকথিত নাট্যদলগুলোর অপপ্রয়াসকে। ক্লাইম্যাক্সের উপস্থিতি এবং বাস্তবতা: একাঙ্ক নাটকেও ক্লাইম্যাক্সের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। ‘বিভাব’ নাটকে দেখা যায় ‘লভ সিন’, ‘প্রগ্রেসিভ লভ সিন’ ইত্যাদি অভিনয় করেও যখন যথেষ্ট হাসির উদ্রেক হল না-তখন শম্ভু মিত্র অমর গাঙ্গুলিকে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন, সেখানে দেখা যায় ‘চাল’, ‘কাপড়’-এর দাবিতে মানুষের মিছিল চলেছে, তাতে পুলিশ গুলি চালায় এবং সামনে থাকা ছেলে মেয়েটি লুটিয়ে পড়ে। সেদিকে তাকিয়ে শম্ভু মিত্র মন্তব্য করেন-“এবার নিশ্চয়ই লোকের খুব হাসি পাবে?” সমগ্র নাটকটি শেষ অবধি গিয়ে দাঁড়ায় এই একটি মন্তব্যের শীর্ষদেশে। এই বাস্তবতাকে আশ্রয় করাই একাঙ্ক নাটকের ধর্ম। মন্তব্য: এইসব সাধারণ বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি গ্রুপ থিয়েটারের নিজস্ব ভাবনার প্রকাশে ভঙ্গিনির্ভর, মঞ্চসজ্জাহীন অভিনয়ের দিকে নাট্যকারের ঝোঁক এবং শুরুতে সূচনা অংশে তাঁর অনুপ্রেরণা হিসেবে দেশ-বিদেশের নানা নাটকের প্রসঙ্গ উল্লেখ, নিঃসন্দেহে এক অন্যরকম সূচনা। এভাবে সর্ব অর্থেই ‘একাঙ্ক’ নাটক হিসেবে ‘বিভাব’ বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে।

You may also like

উচ্চমাধ্যমিক বাংলা কে বাঁচায় কে বাঁচে (গল্প) মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন ও উত্তর
Class 12 Bengali

উচ্চমাধ্যমিক বাংলা কে বাঁচায় কে বাঁচে (গল্প) মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন ও উত্তর

1. “কে বাঁচায় কে বাঁচে” গল্পটি প্রথম কোন্ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়? – ক) কালিকলম খ) পুঁথিপত্র গ) ভৈরব ঘ) মহামন্বন্তর
উচ্চমাধ্যমিক বাংলা ভাত (গল্প) মহাশ্বেতা দেবী প্রশ্ন ও উত্তর
Class 12 Bengali

উচ্চমাধ্যমিক বাংলা ভাত (গল্প) মহাশ্বেতা দেবী প্রশ্ন ও উত্তর

১) “ উনি হলেন দেবতার সেবিকা। ” – ‘ উনি ‘ বলতে কার কথা বােঝানাে হয়েছে? ক) বড়াে বউ খ)