Class 12 Bengali

শিকার কবিতা উচ্চমাধ্যমিক বাংলা বড় প্রশ্ন ও উত্তর

শিকার কবিতা উচ্চমাধ্যমিক বাংলা বড় প্রশ্ন ও উত্তর

উচ্চমাধ্যমিক বাংলা শিকার (কবিতা) জীবানন্দ দাশ প্রশ্ন ও উত্তর  Higher Secondary Bengali Shikar Question and Answer

১.”একটি তারা এখন আকাশে রয়েছে;”‘এখন’ বলতে কোন্ সময়ের কথা বোঝানো হয়েছে? আকাশের তারাকে কেন্দ্র করে কবির ভাবনার যে বিশিষ্টতা প্রকাশিত হয়েছে তা নিজের ভাষায় আলোচনা করো?১+৪

উত্তর:-উদ্দিষ্ট সময়:- রাত্রিশেষে ভোরের আকাশ যখন ঘাস ফড়িংয়ের শরীরের মতো কোমল নীল হয়ে ওঠে, ‘এখন’ বলতে কবি সেই সময়টির কথা বলতে চেয়েছেন।

কবিভাবনার বিশিষ্টতা:- কথামুখ: জীবনানন্দ দাশের মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘শিকার’ কবিতাটি রচিত হয়েছে একটি ‘ভোর’-এর পটভূমিতে। আকাশে তারার উপস্থিতি: অন্ধকারের জরায়ু থেকে জন্ম নেওয়া ভোরে যখন আকাশের রং পালটে যায়, পেয়ারা এবং নোনার গাছের সবুজ ফুটে ওঠে-তখনই আকাশে দেখা যায় একটি তারাকে। যেন রাতের বিদায়ী অস্তিত্বকে সে ধারণ করে রাখে। ভোরের এই তারাকে কবি তুলনা করেন ‘পাড়াগাঁর বাসরঘরে সব চেয়ে গোধূলিমদির’ মেয়েটির সঙ্গে। অর্থাৎ, তারাটির উপস্থিতির সঙ্গে কবি গ্রামবাংলার বাসরঘরের মেয়েটির মতো লজ্জা আর কুণ্ঠাকে তুলনা করেছেন। ‘বাসরঘরে’ আর ‘মদির’ শব্দের ব্যবহারে কবি সেই সলজ্জ স্বভাবকে আরও গভীর করে তোলেন। তারাটির উপস্থিতির সঙ্গে তুলনা: এরপরেই তারাটির উপস্থিতিকে কবি তুলনা করেন ‘মিশরের মানুষী’- র সঙ্গে, যে হাজার হাজার বছর আগে এক রাতে তার বুকের থেকে মুক্তা নিয়ে রেখেছিল কবির নীল মদের গেলাসে। একটু আগে গ্রাম্য মেয়ের সঙ্গে তুলনায় যে সহজতা ছিল তা ভেঙে যায় ঐতিহাসিক আড়ম্বরে। নীল আকাশের ক্যানভাসে রাত-জাগা তারা আর নীল মদের পাত্রে রাখা মুক্তা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ‘মিশরের মানুষী’ আর ‘হাজার হাজার বছর’ মিলে ছবিটি দেশকালের সীমা অতিক্রম করে চিরকালীন বিস্তৃতি পায়। ইতিকথা: ভোরের আকাশের তারা কবির চেতনায় অসামান্য শিল্পরূপ লাভ করে। প্রকৃতির যে স্নিগ্ধ, অমলিন পটভূমি তৈরি করা এখানে কবির লক্ষ্য ছিল, ভোরের তারা তাতে যেন এক নতুন মাত্রা যোগ করে।

২. ‘শিকার’ কবিতাটির প্রথম স্তবকে ব্যবহৃত উপমাগুলি ব্যাখ্যা- সহ আলোচনা করো ?

উত্তর:- ভূমিকা:- চিত্ররূপময় কবি জীবনানন্দ দাশের ‘শিকার’ কবিতাটির সূচনা হয়েছে একটি ভোরের দৃশ্যকে পটভূমি করে। সেই সূত্র ধরেই কবি উপমার জগতে প্রবেশ করেছেন। প্রথম উপমা: প্রথমেই কবি জীবনানন্দ ভোরবেলায় আকাশের রংকে ঘাসফড়িঙের শরীরের মতো কোমল নীল বলে মনে করেছেন। ঘাসফড়িঙের সঙ্গে ভোরের আকাশকে তুলনা করায় প্রকৃতির মধ্যে প্রাণের একটি চাঞ্চল্য স্পষ্টভাবে অনুভব করা যায়। দ্বিতীয় উপমা:-তারপরেই তিনি এই ভোরবেলায় চারদিকের পেয়ারা আর নোনার গাছকে টিয়ার পালকের মতো সবুজ বলেছেন। গাছের পাতাকে পাখির পালকের সঙ্গে তুলনা করার মধ্য দিয়ে প্রকৃতিরাজ্যে প্রাণের স্পর্শ এবং গতিশীলতাকে তুলে ধরা হয়েছে। একটি তারা তখনও আকাশে জেগে রয়ে গেছে যেন সে রাতের বিদায়ী অস্তিত্বকে নিজের মধ্যে ধারণ করে রেখেছে। তৃতীয় উপমা: ভোরের এই তারাকে কবি তুলনা করেছেন পাড়াগাঁর বাসরঘরে ‘সব চেয়ে গোধূলিমদির মেয়েটির’ সঙ্গে। অর্থাৎ তার উপস্থিতির মধ্যে কবি লক্ষ করেন গ্রামবাংলার মেয়েদের মতো লজ্জা এবং কুণ্ঠাকে। ‘বাসরঘরে’ আর ‘মদির’ শব্দের ব্যবহারে কবি সেই লজ্জাকে আরও গভীর ও জীবন্ত করে তুলতে চান। চতুর্থ উপমা: এরপরে তারাটির উপস্থিতিকে কবি তুলনা করেছেন সেই ‘মিশরের মানুষী’-র সঙ্গে, যে হাজার হাজার বছর আগে এক রাতে তার বুকের থেকে মুক্তা নিয়ে রেখেছিল কবির নীল মদের গেলাসে। একটু আগে গ্রাম্য মেয়ের সঙ্গে তুলনায় প্রকৃতির যে সহজতা ছিল, তাও ভেঙে যায় মিশরের এই মানুষীর ঐতিহাসিক আড়ম্বরে। ইতিকথা: ‘মিশরের মানুষী’ আর ‘হাজার হাজার বছর’ মিলে ছবিটি এভাবেই দেশের সীমা অতিক্রম করে এক চিরকালীন বিস্তৃতি পায় ।

৩. “হয়ে গেছে রোগা শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মতো।”- মন্তব্যটির প্রেক্ষাপট ‘শিকার’ কবিতাটি অবলম্বনে আলোচনা করো।?

উত্তর:- শুরুর কথা:- জীবনানন্দ দাশের মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া ‘শিকার’ কবিতার প্রথম অংশে কবি ভোরের আগমনে প্রকৃতির যে রূপান্তর ঘটে তার বর্ণনা দিয়েছেন। প্রকৃতি দৃশ্যের পরিবর্তন: সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আকাশের রং যেমন পালটে যায়, প্রকৃতি হয়ে ওঠে সবুজ-ঠিক সেভাবেই হিমের রাতে দেশোয়ালি মানুষরা তাদের শরীর গরম রাখার জন্য সারারাত মাঠে যে আগুন জ্বেলেছিল- “মোরগফুলের মতো লাল আগুন”- সে আগুনও নিভে আসে। আগুনের রূপের পরিবর্তন: শুকনো অশ্বথপাতায় সে আগুনের অবশেষ জ্বলতে থাকে, কিন্তু তার তেজ আর রং আগের মতো থাকে না। কবির কথায়, সূর্যের আলোয় সেই আগুনের রং আর কুঙ্কুমের মতো থাকে না, হয়ে যায় “রোগা শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মতো।” একটি অসাধারণ উপমানের ব্যবহার করেছেন কবি এখানে, যার সম্পূর্ণটাই আসলে এক অসামান্য চিত্রকল্প। আগুন ও প্রকৃতির অনুষঙ্গ: রাতের অবসানে আগুন নিভে আসে, সূর্যের আলোয় তা ম্লান হয়ে যায়, আর তাকে কবি মিলিয়ে দেন অল্পপ্রাণ এক শালিকের হৃদয়ের ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া ইচ্ছার সঙ্গে। সামান্য একটি স্পর্শযোগ্য বিষয় এখানে অনুভূতির বিষয় হয়ে ওঠে। আর তার থেকে অনেক দীপ্তিমান হয়ে ওঠে চারদিকের বন ও আকাশ, যা সকালের আলোয় টলমল শিশিরে ময়ূরের সবুজ- নীল ডানার মতো ঝিলমিল করে।

৪.”সুন্দর বাদামি হরিণ এই ভোরের জন্য অপেক্ষা করছিল”- হরিণের ভোরের জন্য অপেক্ষার কারণ এবং সেই ভোরকে উপভোগের বর্ণনা দাও ? ২+৩

উত্তর:- হরিণের ভোরের জন্য অপেক্ষার কারণ:- মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া জীবনানন্দ দাশের ‘শিকার’ কবিতায় ভোরের মনোরম বনভূমিতে সুন্দর বাদামি রঙের হরিণটির আবির্ভাব হয়। “নক্ষত্রহীন, মেহগনির মতো অন্ধকারে” সারারাত চিতাবাঘিনির গ্রাস থেকে নিজেকে বাঁচাতে সুন্দরীর বন থেকে অর্জুনের বনে ঘুরে বেড়িয়েছিল হরিণটি। দিনের আলোয় নিজেকে রক্ষার তাগিদেই সে অপেক্ষা করেছিল ভোরের জন্য।
ভোের উপভোগ:- ভোরের আলোয় নেমে আসা: ভোরের আলোয় হরিণটি বনের বাইরে বেরিয়ে আসে এবং কচি বাতাবিলেবুর মতো সবুজ, সুগন্ধি ঘাস ছিঁড়ে খায়। তারপরে নেমে যায় নদীর শীতল জলে-তার ঘুমহীন ক্লান্ত শরীরকে সতেজ করার জন্য, বিহ্বল শরীরটাকে স্রোতের মতো একটা শীতল আবেশ দেওয়ার জন্য। জীবনের উল্লাস খোঁজার প্রয়াস: অন্ধকারের জরায়ু থেকে জন্ম নেওয়া ভোরের রোদের মতোই জীবনের উল্লাস খুঁজে নিতে চেয়েছিল হরিণটি। চেয়েছিল নীল আকাশের নীচে ‘সূর্যের সোনার বর্শার মতো’ জেগে উঠতে। কবির অনুভবে, সেই হরিণের লক্ষ্য ছিল ‘সাহসে সাধে সৌন্দর্যে’ অন্যান্য হরিণীকে চমকে দেওয়া। মেলে ধরার সুযোগ: এইভাবে মনোরম অরণ্যপ্রকৃতিতে হরিণটি যেন নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ পেয়ে যায়। প্রাণবন্ত, চঞ্চল হরিণটি প্রকৃতিকে নিজের স্বচ্ছন্দ বিচরণের ক্ষেত্র মনে করে। সম্ভবত হরিণটির নির্মম পরিণতির কথা চিন্তা করেই জীবনের এই উদ্যাপন কবি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন।

৫.”এসেছে সে ভোরের আলোয় নেমে; “-কেন সে নেমে এসেছে? তার পরিণতির আক্ষরিক ও রূপকার্থ বিশ্লেষণ করো। ২+৩
অথবা, “এসেছে সে ভোরের আলোয় নেমে;”-সেই ভোরের বর্ণনা দাও। ‘সে’ ভোরের আলোয় নেমে আসার পর কী কী ঘটল, লেখো। ?

উত্তর:- নেমে আসার কারণ:- জীবনানন্দ দাশের ‘শিকার’ কবিতায় ‘ভোর’- এর পটভূমিতে যখন চারপাশ উদ্ভাসিত, সকালের আলোয় শিশিরভেজা চারদিকের বন ও আকাশ যখন ‘ময়ূরের সবুজ নীল ডানার মতো ঝিলমিল করছে’, সেই সময় একটি সুন্দর বাদামি হরিণকে ভোরের আলোয় নেমে আসতে দেখা যায়। সমস্ত রাত চিতাবাঘিনির হাত থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য হরিণটি ‘নক্ষত্রহীন, মেহগনির মতো অন্ধকারে’ সুন্দরীর বন থেকে অর্জুনের বনে ঘুরে বেড়িয়েছিল। তার ভোরের জন্য অপেক্ষার কারণ ছিল মুক্তির পরিসর খুঁজে পাওয়া।
পরিণতির বিশ্লেষণ:- আক্ষরিক অর্থ: হরিণটির পরিণতি ছিল মর্মান্তিক। প্রথমে বন্দুকের গুলির শব্দ শোনা যায়। তারপরই নদীর জল যেন মচকাফুলের পাপড়ির মতো লাল হয়ে ওঠে। যে হরিণটি ভোরের আলোয় নদীতে নেমেছিল নিজের ঘুমহীন ক্লান্ত শরীরকে স্রোতের মতো একটা আবেশ দেওয়ার জন্য, তাকেই দেখা যায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ‘উয় লাল’ মাংসপিন্ডে রূপান্তরিত হতে। রূপক অর্থা:- এই পরিণতি এক গভীর সমাজবাস্তবতাকে নির্দেশ করে। প্রকৃতির বুকে নাগরিক সভ্যতার আগ্রাসনের নিদর্শন হয়ে থাকে হরিণের এই মৃত্যু। ‘নক্ষত্রের নীচে ঘাসের বিছানায়’ সিগারেটের ধোঁয়া আর ‘টেরিকাটা কয়েকটা মানুষের মাথা’ নিশ্চিত করে দেয় নগরসভ্যতার বিকৃত লালসা মেটাতেই প্রাণ দিতে হয়েছে হরিণটিকে। হরিণটি আসলে সমগ্র প্রকৃতির প্রতীক, আসলে প্রকৃতিকেই এভাবে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে উদ্ধত মানবসভ্যতার কাছে ।

৬.”সাহসে সাধে সৌন্দর্যে হরিণীর পর হরিণীকে চমক লাগিয়ে দেবার জন্য।”-মন্তব্যটির প্রসঙ্গ উল্লেখ করো। এই আকাঙ্ক্ষা কি পূরণ হয়েছিল? ৩+২

উত্তর প্রসঙ্গ:- জীবনানন্দ দাশের লেখা ‘শিকার’ কবিতায় সারারাত চিতাবাঘিনির হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে গভীর অন্ধকারে সুন্দরীর বন থেকে অর্জুনের বনে ঘুরে ঘুরে একটি সুন্দর বাদামি হরিণ চলে এসেছিল ভোরের আলোয়। ঝলমল করে ওঠা সকালের কাছে সে খুঁজেছিল নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতি। ছিঁড়ে খেয়েছিল বাতাবিলেবুর মতো সবুজ সুগন্ধি ঘাস। তারপরে গা ভাসিয়েছিল নদীর কনকনে ঠান্ডা জলে। ঘুমহীন, ক্লান্ত, বিহবল শরীরকে সে দিতে চেয়েছিল স্রোতের আবেশ। অন্ধকারের জরায়ু থেকে জন্ম নেওয়া ভোরের রোদের মতোই জীবনের উল্লাস খুঁজে নিতে চেয়েছিল হরিণটি। নীল আকাশের নীচে সে জেগে উঠতে চেয়েছিল সূর্যের”সোনার বর্ণার মতো।” অন্যান্য হরিণীকে চমকে দেওয়ার জন্য নিজেকে এভাবেই যেন সাজিয়ে তুলতে চেয়েছিল সেই সুন্দর বাদামি হরিণটি।
আকাঙ্ক্ষার পরিণতি:- তথাকথিত সভ্যসমাজ হরিণের এই আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করতে দেয়নি। প্রকৃতির কোমলতার মাঝে হঠাৎ ভেসে এসেছিল এক অদ্ভুত শব্দ। আর তারপরই নদীর জল হয়ে উঠেছিল মচকাফুলের মতো লাল। প্রাণবন্ত হরিণটি পরিণত হল নিষ্প্রাণ মাংসপিণ্ডে। ঘুমের দেশেই যেন সে হারিয়ে গেল। সিগারেটের ধোঁয়ায় আর গল্পে মশগুল নাগরিক সমাজের বিকৃত জীবন উদ্যাপনে হরিণের সাধ ও আহ্লাদের অবসান ঘটে। হয়তো নাগরিকজীবনের কাছে প্রকৃতির পরাজয়ের প্রতীক হয়ে থাকে হরিণের এই মৃত্যু ।

৭. “আগুন জ্বলল আবার…”- ‘আবার’ শব্দটি প্রয়োগের তাৎপর্য কী? এখানে এই ঘটনা কীসের ইঙ্গিত দেয়? ৩+২

উত্তর ‘আবার’ শব্দপ্রয়োগের তাৎপর্য:- জীবনানন্দ দাশের ‘শিকার’ কবিতায় আগুনের চিত্রকল্পটি দু-বার ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমবার দেশোয়ালি মানুষেরা শীতের রাতে শরীর গরম রাখার জন্য এই আগুন জ্বালিয়েছিল। মোরগফুলের মতো সেই লাল আগুন ভোর হওয়ার পরেও জ্বলছিল। কিন্তু সকালের আলোয় ‘রোগা শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মতো’ ম্লান হয়ে যাওয়া সেই আগুনেই ছিল ভোরের ইঙ্গিত, জীবনের জেগে ওঠার আভাস। দ্বিতীয়বার এই আগুনের প্রসঙ্গ ফিরে এসেছে কবিতার শেষে। সুন্দর বাদামি হরিণ সারারাত চিতাবাঘিনির হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিশ্চিন্ত ভোরে বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু শিকারির গুলি নদীর জলে আবেশ খোঁজা তার ক্লান্ত শরীরকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল। এরপরেই আবার আগুন জ্বলেছিল। কিন্তু সেখানে জীবনের জাগরণ ছিল না। ছিল জীবন নাশের আয়োজন। জ্বলন্ত আগুনে উয় লাল হরিণের মাংস তৈরি হয়ে আসে। ‘আবার’ শব্দটির সাহায্যে এই দ্বিতীয়বারের আগুন জ্বলার কথাই বলা হয়েছে।
ঘটনার ইঙ্গিতময়তা:- দ্বিতীয়বার আগুন জ্বলার ঘটনা শুধু একটা হরিণশিকারের কাহিনি নয়। নির্মল প্রকৃতির বুকে নাগরিক সমাজের যে আগ্রাসন তারও প্রতীক এই ঘটনা। তার সঙ্গে সিগারেটের ধোঁয়া, টেরিকাটা মাথা-এসব মিলে নাগরিক নৃশংসতার যে আয়োজন হয়, প্রকৃতির সারল্য আর নিজস্বতা হারিয়ে যায় সেই অন্ধ মানবসভ্যতার কাছে। সেই ইঙ্গিতই যেন দেখা যায় প্রশ্নোদ্ভূত পঙ্ক্তিতে।

 

৮. উয় লাল হরিণের মাংস তৈরি হয়ে এল।” -মাংসলোভী মানুষের যে হিংস্রতার পরিচয় ‘শিকার’ কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে, তা নিজের ভাষায় বর্ণনা করো ?

উত্তর মানুষের হিংস্রতার পরিচয়:- প্রাক্কখন:- জীবনানন্দ দাশের ‘শিকার’ কবিতার পটভূমিতে আছে এক নির্মল ‘ভোর’।
প্রকৃতির রূপ:- সেখানে ‘আকাশের রং’ ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল। টিয়ার পালকের মতো সবুজ পেয়ারা ও নোনার গাছ। সকালের আলোয় টলমলে শিশিরে চারদিকের বন ও আকাশ ঝিলমিল করছে। এই অসামান্য ভোরেই বেঁচে থাকার পরিসর খুঁজেছিল সুন্দর বাদামি হরিণ। হরিণের বেঁচে থাকার উল্লাস: সারারাত এক বন থেকে অন্য বনে পালিয়ে চিতাবাঘিনির হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে এই ভোরের আলোয় হরিণটি বেঁচে থাকার উল্লাস উপভোগ করতে চেয়েছিল। সে ভোরের আলোয় ছিঁড়ে খেয়েছিল কচি বাতাবিলেবুর মতো সবুজ সুগন্ধি ঘাস আর ‘নদীর তীক্ষ্ণ শীতল ঢেউয়ে’ নেমেছিল রাতজাগার ক্লান্তি মেটাতে। নাগরিক মানুষের লালসা:- ভোরের আলোয় হরিণটি যখন জীবনের উল্লাস খুঁজে নিচ্ছিল, ঠিক তখনই ভেসে আসে বন্দুকের গুলির শব্দ আর নদীর জল হরিণের রক্তে হয়ে ওঠে ‘মচকাফুলের পাপড়ির মতো লাল’। নাগরিক মানুষের লালসা মেটাতে নিষ্পাপ হরিণটি ‘উয় লাল’ মাংসে পরিণত হয়। উপসংহার: নক্ষত্রের নীচে ঘাসের বিছানায় বসে অনেক পুরোনো শিশিরভেজা গল্প আর সিগারেটের ধোঁয়ায় সভ্যতার যে চিহ্ন দেখা যায় তাতে স্পষ্ট হয় সভ্যসমাজের নৃশংসতায় চিরকালের ঘুমের দেশে নিষ্পাপ জীবনের হারিয়ে যাওয়ার কাহিনিই ।

৯.শিকার’ কবিতায় কবি ভোরের প্রকৃতি ও জীবনের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা নিজের ভাষায় লেখো।
অথবা, ‘শিকার’ কবিতায় ভোরের প্রথম পর্যায়ের যে ছবি ফুটে উঠেছে, তা নিজের ভাষায় লেখো।

উত্তর:- ‘শিকার’ কবিতায় প্রকৃতি ও জীবনের বর্ণনা:- সূচনা: জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘শিকার’ কবিতায় একটি বাদামি হরিণের হত্যার পটভূমিতে ভোরের এক বিপরীত রূপ তুলে ধরেছেন। ভোরের আকাশ: ভোরের আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল। চারদিকের পেয়ারা আর নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ। একটি তারা তখনও আকাশে ছিল। হিমের রাতে শরীর গরম করার জন্য দেশোয়ালিরা রাতে মাঠে যে আগুন জ্বেলেছিল, শুকনো অশ্বথপাতায় তা তখনও জ্বলছিল। ভোরের সূর্য:- ভোরের সূর্যের আলোয় আগুনের শিখাও তার আগের জ্যোতি হারিয়ে ম্লান হয়ে গিয়েছিল। সকালের আলোয় শিশিরভেজা বন ও আকাশ যেন ময়ূরের সবুজ- নীল ডানার মতো ঝিলমিল করছিল। সূর্যের প্রথম আলোয় উদ্ভাসিত প্রকৃতির ছবি জীবনানন্দ তুলে ধরেছেন তাঁর কবিতায়। ভোরের বুকে নৃশংসতা: কিন্তু পরে শিকারির বন্দুকের গুলিতে সুন্দর বাদামি হরিণের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে নৃশংস দৃশ্য তৈরি হয়, তার পটভূমিতে প্রকৃতির এই নির্মল ছবি যেন সেই নৃশংসতাকে আরও নির্মম করে তোলে। এই ঘটনা প্রকৃতির বুকে মানুষের হৃদয়হীনতার স্বরূপকেই প্রকাশ করে। প্রাণবন্ত হরিণের ‘উয় লাল’ মাংসে রূপান্তর, নাগরিক সভ্যতার হাতে প্রকৃতির ধ্বংসের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।

১০.শিকার’ কবিতায় ‘ডোর’ শব্দটি কীভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে আলোচনা করো।

অথবা, ‘শিকার’ কবিতায় যে দুটি ভোরের চিত্র আছে তার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

অথবা, “ভোর-এই শব্দটিই যেন ‘শিকার’ কবিতার দুটি অংশে প্রবেশের দুটি চাবি, যা এই কবিতার শুরুতে এবং মাঝে উচ্চারিত হয়েছে।”- ‘শিকার’ কবিতার বিষয়বস্তু আলোচনা করে উদ্ধৃত বক্তব্যটি বিশ্লেষণ করো।

অথবা, ‘শিকার’ কবিতায় ভোরের পরিবেশ যেভাবে চিত্রিত হয়েছে, তা নিজের ভাষায় লেখো। সেই পরিবেশ কোন ঘটনায় করুণ হয়ে উঠল?৩+২

উত্তর:- ‘ভোর’-এর তাৎপর্য: শুরুর কথা:- জীবনানন্দ দাশ তাঁর মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া ‘শিকার’ কবিতায় রাত্রিশেষে ‘ভোর’ হওয়ার ঘটনাকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে ব্যবহার করেছেন। প্রথম ভোরের বর্ণনা: কবিতার প্রথম অংশে ‘ভোর’ যেন নির্মল প্রকৃতির আত্মপ্রকাশের উপযুক্ত পটভূমি। তখন আকাশের রং “ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল”, চারদিকের পেয়ারা ও নোনার গাছের রং “টিয়ার পালকের মতো সবুজ”। সেই ভোরেই আকাশে জেগে থাকা একমাত্র তারাটি কবির মনে বিপরীত অনুভবের ভালো লাগা তৈরি করে। এই ভোরেই অল্পপ্রাণ শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মতো ম্লান হয়ে যায় হিমের রাতে দেশোয়ালিদের জ্বালানো আগুনের শিখা। সকালের আলোয় টলমল শিশিরে ঝিলমিল করে ওঠে চারপাশের বন ও আকাশ। দ্বিতীয় ভোরের বর্ণনা:- এই ভোরের পটভূমিতেই কবিতায় আগমন ঘটে একটি ‘সুন্দর বাদামি’ হরিণের। তার কচি বাতাবিলেবুর মতো সবুজ, সুগন্ধি ঘাস ছিঁড়ে খাওয়া বা নদীর জলে ঘুমহীন, ক্লান্ত শরীর ভেজানোর মধ্য দিয়ে জীবনের স্বচ্ছন্দ বিচরণকেই প্রত্যক্ষ করা যায়। কিন্তু সুন্দরের এই সহজ প্রকাশকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়’একটা অদ্ভুত শব্দ’। নদীর জল এরপর মচকাফুলের মতো লাল হয়ে ওঠে হরিণের রক্তে। শিকারি মানুষের লোভের শিকার হয়ে হরিণটিকে চলে যেতে হয় ‘নিস্পন্দ নিরপরাধ ঘুম’-এর দেশে। তৈরি হয় ‘ভোর’-এর আর-এক ছবি।

উপসংহার:- এই ভোরকে প্রকৃতি লালন করেনি; কিংবা সারারাত চিতাবাঘিনির হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে হরিণও এই ভোরের জন্য অপেক্ষা করেনি। মানুষের ক্ষুধার ও হিংস্রতার সাক্ষী হয়ে থাকে এই ভোর।

You may also like

উচ্চমাধ্যমিক বাংলা কে বাঁচায় কে বাঁচে (গল্প) মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন ও উত্তর
Class 12 Bengali

উচ্চমাধ্যমিক বাংলা কে বাঁচায় কে বাঁচে (গল্প) মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন ও উত্তর

1. “কে বাঁচায় কে বাঁচে” গল্পটি প্রথম কোন্ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়? – ক) কালিকলম খ) পুঁথিপত্র গ) ভৈরব ঘ) মহামন্বন্তর
উচ্চমাধ্যমিক বাংলা ভাত (গল্প) মহাশ্বেতা দেবী প্রশ্ন ও উত্তর
Class 12 Bengali

উচ্চমাধ্যমিক বাংলা ভাত (গল্প) মহাশ্বেতা দেবী প্রশ্ন ও উত্তর

১) “ উনি হলেন দেবতার সেবিকা। ” – ‘ উনি ‘ বলতে কার কথা বােঝানাে হয়েছে? ক) বড়াে বউ খ)